আমি মীর মোহাম্মদ শরীফ মাহমুদ। কবি আল মাহমুদের বড় ছেলে।
আমরা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। আমি বড় ছেলে হিসেবে কিছু কথা বলতে চাই।
আমি যখন ভাবি আমি কবি আল মাহমুদের ছেলে তখন নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। আনন্দে মনটা ভরে যায়।
কখনো সচ্ছলভাবে কখনো অসচ্ছলভাবে আমরা বেড়ে উঠেছি। আব্বা সব ছেলে-মেয়েকে সাধ্যমত লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করেছেন। সবাই মোটামুটি শিক্ষিত। আল মাহমুদ কবি হিসেবে গড়ে ওঠার পিছনে আমার মায়ের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ আমার আম্মা নানা দুঃখ কষ্টের মধ্যে থেকেও আব্বাকে সহযোগিতা করেছেন। যেন ওনার লেখালেখির ব্যাপারে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সে দিকে খেয়াল রেখেছেন।
আব্বা শুধু কবিতাকে অবলম্বন করে ঢাকায় আসেন জীবিকা অর্জনের জন্য। ঢাকায় এসে একটি চাকরি নেন দৈনিক ইত্তেফাকে। ইত্তেফাকে তখন আমাদের দু’জন আত্মীয় চাকরি করতেন। তাদের একজন মীর আবদুল হাদি অন্যজন লুৎফর রহমান। দু’জনই আব্বার চাচা হন।
চাকরি পাওয়ার পর আমার মা আর দু’ছেলেকে নিয়ে নারিন্দা বসু বাজার লেনে দুই কামরার একটি বাসা ভাড়া নেন। আমি শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে আর ছোট ভাই আরিফ তখন শৈশবে।
একবার কোরবানির ঈদের দিন।
আমাদের বাড়িতে দু’জন ভদ্রলোক এলেন। একজন লম্বা চওড়া মাথা ভর্তি কুঁকড়ানো চুল। স্বাস্থ্যবান। প্যান্ট শার্ট পরা। আর একজন পায়জামা পাঞ্জাবি পরা, একটু হালকা পাতলা। আব্বা বললেন ওনাদের সালাম কর। সালাম করলাম। প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক আমাকে পাঁচটি টাকা দিলেন। আমিতো খুশিতে আত্মহারা। তখনতো উনাকে চিনতে পারিনি কিন্তু এখন চিনতে পারছি। উনি আর কেউ নন। উনি কবি শহীদ কাদরী। বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি।
২. একদিন আমাকে ডেকে আব্বা-আম্মা দু’জনই বললেন, আগামীকাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিস। আম্মা বললেন, তোর আব্বা তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন। আমিতো খুশি। কারণ আমার বন্ধুরা সবাই স্কুলে পড়ে। স্কুলটি টিপু সুলতান রোডে, সলিমুল্লাহ গ্র্যাজুয়েট হাইস্কুল (নওয়াব স্যার সলিমুল্লার নামে স্কুলটি)। আমাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। সালটি আমার মনে নেই। ভর্তি হয়ে দেখি কয়েকজন আমাদের মহল্লার। এদের দু’জন আমার বন্ধু রণজিৎ আর শওকত। স্কুল শুরু হতো প্যারেড ও পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ দিয়ে। জাতীয় সঙ্গীতটি তেমন আর মনে নেই। স্কুলটির বামপাশে অর্থাৎ উত্তর দিকে কোনাকুনি বরাবর একটি কালীমন্দির ছিল। এখনো আছে। সারাদিনই পূজা হতো।
যাইহোক আমি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়লাম ঐ স্কুলে। আব্বা বাসা বদলালেন উত্তর শাহজাহানপুরে। আব্বা তখন কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দু’টি কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
শাহজাহানপুরে ‘ঝিল কুঠির’ নামে একটি বাড়িতে এসে উঠলাম। বাড়িটি রাস্তা থেকে ঝিল পর্যন্ত বিস্তৃত। বাড়িটি তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশে একজন ব্যবসায়ী ভদ্রলোক থাকতেন। উনার ৩-৪ জন ছেলেমেয়ে ছিল। ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিলেন বেশ মোটাসোটা। সহজ ও সরল কিসিমের।
দ্বিতীয় অংশে থাকতেন আনসার উদ্দীন নামে এক ভদ্রলোক। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। উনার স্ত্রী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওনাদের একটি মাত্র মেয়ে ছিল। সেও মায়ের স্কুলে পড়াশুনা করতো।
তৃতীয় অংশে অর্থাৎ শেষ অংশে আমরা যে অংশে থাকতাম সেটি ছিল ঝিল লাগোয়া। ঝিলটি ছিল বিশাল বড়। ছোটখাটো একটি বিলের মতো। বাড়িওয়ালা থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। আমাদের বাসাটির ছিল ২টি বেডরুম, ১টি গোসলখানা, ১টি রান্নাঘর ও ১টি বাথরুম। আর ছিল একটি বিরাট বারান্দা। বারান্দার অর্ধেক অংশে একটি রুম বানিয়ে ফেলি। সেখানে আমি থাকতাম। বাকি অংশটা বৈঠকখানার মতো কাজে লাগতো। বাড়িভাড়া ছিল প্রায় তিন শ’ টাকা।
ইতোমধ্যে আমার আরও এক ভাই জন্ম নেয়। তার নাম রাখা হয় তারিক।
অনেক কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আমাদের বাসায় আসতেন। রীতিমতো আড্ডা জমে যেত। তাদের মধ্যে কবি আবুল হাসান (প্রয়াত) নামটা ভুলও হতে পারে। এখন পুরোপুরি মনে করতে পারছি না। কবি সুরাইয়া খানম, উনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। খুবই সুন্দরী। আর আসতেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি অসীম সাহাসহ আরো অনেকে। তাদের অনেকের নাম আমি জানি না বা আজ আর মনে নেই।
আব্বাকে নিয়ে পরের স্মৃতিতো অনেক। বিশাল! সুযোগ মতো সেসব পর্যায়ক্রমে বলার চেষ্টা করবো।
লেখক : কবি আল মাহমুদের জ্যেষ্ঠপুত্র