আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করি। সময়টা ১৯৭৮ সাল। তখন সকাল থেকে অনেক রাত অবধি হাসপাতালে কাজ করতে হতো। সে সময় একদিন সন্ধ্যার কিছু পর আমার পরিচিত এক যুবক একজন মাঝবয়সী লোক নিয়ে হাজির হলো হাসপাতালে, আমার অফিসে। যুবক তার সাথে আগত লোকটিকে দেখিয়ে বললেন ইনি কবি আল মাহমুদ, আমাদের আগামীকালের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। মাহমুদ ভাইয়ের চোখে সমস্যা আপনাকে একটু দেখতে হবে।
কবিকে দেখে আমার বুকের মধ্যে ভালো লাগা দোল খেয়ে গেল। কবির নাম শোনা হয়েছিল অনেক আগেই। দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক গ্রেফতার হয়েছেন, জেলে গেছেন সংবাদের সুবাদে। তখন তার পরিচয় বিপ্লবী সাংবাদিক এবং কবি হিসেবে। কবিতা পড়ার নেশা ছিলো, ফলে তার লেখার সাথে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। এর ভেতরেই তিনি বাংলা সাহিত্যে বিস্ফোরণ ঘটালেন কবিতা গ্রন্থ ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ দিয়ে। আল মাহমুদ তখন সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতমদের একজন। এই প্রথম তাকে সামনাসামনি দেখলাম।
আমি কবির দিকে অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। সহজ সরল অকপট চেহারা। পোশাক-আশাকে নেই কোন বাড়াবাড়ি। কবির সাথে আসা যুবক বললেন, ডাক্তার ভাই, মাহমুদ ভাইয়ের চোখ দুটো ভালো করে দেখে দিন। অনেক ভেবেচিন্তে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। একজন তরুণ চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে তখন আমার বেশ একটা সুনাম ছিলো বলেই বোধ হয় তিনি আমার কাছে কবিকে নিয়ে এসেছেন। আমি মাহমুদ ভাইয়ের চোখ পরীক্ষা করে কিছুটা হতাশ হলাম। তখন তার চোখের অবস্থা অনেকটাই জটিল। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দিলাম বটে কিন্তু তার চোখের ভবিষ্যৎ যে আদৌ ভালো নয় সেটা মুখের ওপর বললাম না। শুধু বললাম আপনার চোখ নিয়ে আপনাকে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে। চোখ দেখানোর পর অনেক সময় ধরে তিনি আমার চেম্বারে বসলেন। অনেক কথা হলো। প্রথম পরিচয়েই আমরা মনের দিক হতে একে অপরের অনেকখানি আপন হয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় কবি বললেন-ডাক্তার ভাই, আগামীকালের অনুষ্ঠানে আসেন, আমার কবিতা শোনার দাওয়াত রইলো। কবিকে সাথে করে নিয়ে আসা অনুষ্ঠানের আয়োজক যুবকও অনুষ্ঠানের যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে কবিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার ক্ষণিকের সঙ্গ আমাকে অনেকক্ষণ আবিষ্ট করে রাখলো। আর পরের দিন অনুষ্ঠানের যোগ দেয়ার জন্য আমার হৃদয় ঝুলে রইলো।
পরের দিন সারাদিন হাসপাতালে রোগী দেখলাম। কিন্তু মন থেকে একবারের জন্যও তাকে সরাতে পারলাম না। বুঝলাম একজন কবির আত্মিক প্রভাব কতটা প্রখর হলে এমন হয়। সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম অডিটোরিয়ামে। দর্শকসমাগমে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে পুরো অডিটোরিয়াম। আলোচনা চলছিল। সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক নানান আলোচনা। আমি অতটা মনোযোগী হতে পারছিলাম না। কবির স্বকণ্ঠে কবিতা শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো হয়তো। এক সময় ধীরপদে কবি এসে দাঁড়ালেন ডায়াসে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ প্রাণবন্ত আলোচনা করলেন বিভিন্ন বিষয়ে। এর পর আবৃত্তি শুরু করলেন। মায়াবী পর্দা দুলে উঠো কবিতাটি। তিনি যখন আবৃত্তি শুরু করলেন তার কণ্ঠ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই পুরো অডিটোরিয়ামে। নিঃশ্বাসের শব্দও নেই। পুরো অডিটোরিয়ামের দর্শক-শ্রোতাসহ সবকিছু যেন সম্মোহিত হয়ে পড়েছে। আমি তো তার কবিতার শব্দমালার সাথে একাকার হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। কবিতা পাঠ শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হয় নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন।
পরদিন কবি ঢাকায় ফিরে গেলেন। কিন্তু আমার মনোজগতে তার বিচরণ রয়ে গেল। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি আমি পেশাগত প্রয়োজনে দেশের বাইরে চলে যাই। প্রবাসে বসে তার নানা লেখা পড়েছি। মাঝে বেশ কয়েকবার দেশে এসেছি। কিন্তু কবির সাথে আর সেভাবে দেখা হয়নি। বিদেশের মাটিতে অনেকগুলো বছর পার করে উনিশ শ’ চুরানব্বই সালে আমি স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসি। দেশে আসার পর ধানমন্ডির ভিশন আই হসপিটালে চেম্বার শুরু করি। ভিশন আই হসপিটালেই কবি আল মাহমুদের সাথে আবার আমার সাক্ষাৎ হয়। এবারও ঐ একই বিষয়। চোখের চিকিৎসা। তিনি এখানে আমার কাছে নিয়মিত আসতেন। চোখের কারণেই আসতে হতো। কবি জাকির আবু জাফর তাকে সাথে নিয়ে আসতেন। নিজ দায়িত্বেই জাকির আবু জাফর মাহমুদ ভাইকে আমার কাছে আনা-নেয়া করতেন। মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। তিনি চেম্বারে এসে বসে থাকতেন। সব রোগী দেখা হয়ে গেলে তিনি চেম্বারে ঢুকতেন। চোখ দেখার ফাঁকে ফাঁকে তো কথা হতোই, চোখ দেখা শেষে দীর্ঘ সময় আড্ডা চলতো আমাদের। জীবন আর সাহিত্যের নানান বিষয় নিয়ে কথা হতো। কথা হতো সমসাময়িক বিষয়েও। প্রত্যেক বারই আসার সময় আমার জন্য তিনি বই নিয়ে আসতেন। বেশির ভাগই তার নিজের বই। পরেরবার এসে আগেরবার দেয়া বইয়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন পড়েছি কি না। ডাক্তারির ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও তাঁর বইগুলো পড়তাম। জিজ্ঞেস করলে যাতে হ্যাঁ বলতে পারি সে কারণেও পড়তে হতো। একজন কবির মনের মধ্যে সব সময় একটা আকুতি থাকে, তাঁর লেখা মানুষ পড়ুক, বুঝুক, উপভোগ করুক। মাহমুদ ভাইয়ের মধ্যে তা ষোল আনা দেখতাম। তিনি পরিকল্পনা করে পাঠক তৈরি করতেন। মানুষের ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও যেন মানুষ বই পড়ে, মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। সেটা তিনি সব সময় চাইতেন। তিনি নিজেও দিনরাত পড়াশোনা করতেন। মাহমুদ ভাই মনে করতেন অধিক বই পড়ার কারণেই তাঁর চোখের অবস্থা খারাপ হয়েছে। আসলে তাঁর চোখের অবস্থা এতটা খারাপ ছিলো যে তা আর ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। এ সমস্যার আসলে কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। এ সমস্যায় চোখ যখন যে অবস্থায় থাকে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে তা ব্যবহার উপযোগী রাখতে হয়। চোখের কারণে মাহমুদ ভাই ঠিকমত পড়াশোনা এবং লেখালেখি করতে না পেরে অনেকটাই অস্থির হয়ে উঠলেন। আমরাও মাহমুদ ভাইয়ের চোখের বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম। কবি জাকির আবু জাফর এবং আরও কয়েকজন সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকসহ আমরা এ বিষয়ে কী করা যায় তা নিয়ে কয়েক দফা বসলাম। সেটা দুই হাজার সালের আগে কিংবা পরে হবে। এক পর্যায়ে আমি প্রথমে তাঁর চোখ অপারেশন এবং পরে বিশেষ ধরনের লাইটিং সমৃদ্ধ রিডিং টেবিলের ব্যবস্থার পরামর্শ দিলাম। আমার তত্ত্বাবধানে তাঁর বাসায় এ বিশেষ ধরনের টেবিলের আয়োজন করা হলো। এতে তিনি বেশ কয়েক বছর মোটামুটি পড়া এবং লেখার কাজ করতে পেরেছেন। এ সময় ছায়ার মত তাঁর সাথে লেগে ছিলেন কবি জাকির আবু জাফর। একপর্যায়ে তাঁর চোখ দুটো এই বিশেষ টেবিলের ব্যবহারের উপযোগিতাও হারালো। তখন তিনি অন্যের সহযোগিতায় লেখার কাজ শুরু করলেন। নিকটজনরা বই এবং পত্রিকা পড়ে শোনাতেন। এ অবস্থায় আমার চেম্বারে তিনি আরো কয়েকবার এসেছেন। অন্ধত্ব নিয়ে তিনি নানান কথা বলতেন। অতীতের বেশ কয়েকজন অন্ধ হয়ে যাওয়া খ্যাতিমান কবি এবং লেখকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি অন্ধত্বের ইতিবাচক বেশ কিছু দিক আমাকে বলতেন। তিনি বলেন-আমার মনে হয় চোখের আলো নিভে গেলে মনের আলোর তীব্রতা বেড়ে যায়। আর সে আলোয় জীবনের সব রহস্য একজন কবির সামনে উন্মিলিত হয়। একজন কবি এ অবস্থায় আরো বেশি পরিণত হয়। আরো বেশি পূর্ণতা লাভ করে। চোখের আলো হারানো মাহমুদ ভাইয়ের এ উপলব্ধি তাঁর নিজেকে কেবল বুঝ দেয়ার জন্য ছিল না। এ অবস্থায় অন্যের সাহায্যে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। আমার মনে হয় এ লেখাগুলোর গভীরতা আগের লেখার চেয়ে অনেক বেশি। এ পর্যায়ের লেখাগুলোর স্বাদ অন্যরকম। তিনি তাঁর অন্ধত্বকে নানাভাবে তাঁর অনেক লেখায় এনেছেন। বিষয়টা নিয়ে অনেক সময় তিনি আক্ষেপও করেছেন। আবার আশীর্বাদও মনে করেছেন।
ধীরে ধীরে মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হওয়ার পরিমাণ কমে গেল। চোখের জন্য যেহেতু আমার কাছে তিনি আসতেন সে চোখ দুটো যখন চিকিৎসার অনুপযোগী হয়ে গেল তখন স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে সাক্ষাতের পরিমাণ কমে গেল। কিন্তু মনের নৈকট্যে আমাদের এতটুকুও যতি কখনো পড়েনি। আমার পরিচিত জনরা তাঁর বাসায় গেলে আমার খোঁজখবর জানতেন। সালাম পাঠাতেন। আমিও তাঁর বাসায় মাঝে মধ্যে যেতাম। বিশেষ করে তাঁর জন্মদিনে।
মাহমুদ ভাইয়ের সাথে সেভাবে নিয়মিত দেখা না হলেও তার লেখা নিয়মিত পাঠ করতাম। একটি পত্রিকায় ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ শিরোনামে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ছাপা শুরু হয়েছিল। সে কলামগুলোর প্রায় সবই পড়েছি সে সময়। এরপর দুই হাজার আট সালের দিকে দিগন্ত টিভিতে একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা শুরু করি আমি। মাহবুব মুকুলের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘একান্ত সংলাপ’। জীবন্ত কিংবদন্তিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে সাক্ষাৎকারধর্মী এই অনুষ্ঠানের একটা পর্বে মাহমুদ ভাইকে আমরা নিয়ে আসি। মাহমুদ ভাই তখন চোখে আর দেখতে পান না বললেই চলে, বধিরতাও পেয়ে বসেছে তখন। বহুদিন পর আবার সামনাসামনি বসলাম। আগে চোখ দেখার জন্য বসেছি অসংখ্যবার। আর এবার বসেছি সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য।
টেলিভিশনের সেই অনুষ্ঠানে মাহমুদ ভাইয়ের সাথে একেবারে খোলামেলা কথা হয়। যদিও একই প্রশ্ন বার বার বলে তার বোধগম্য করতে হলো। আংশিক বধিরতার কারণে আমার কথা শুনতে তাঁর বেশ সমস্যা হচ্ছিল। তারপরও তাঁর জীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা, বেড়ে ওঠা, লেখালেখি, পরিবার, দেশ, সমাজসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে অনেক প্রাণবন্ত ‘একান্ত সংলাপ’ করি আমরা। তিনি সব কথা কোন দ্বিধা না করে বলেছিলেন সেদিন। আমার মনে হয় এটা ছিলো মাহমুদ ভাইয়ের জীবনের অন্যতম প্রধান একটি ভিজ্যুয়াল সাক্ষাৎকার। এই অনুষ্ঠানে তিনি হাসির প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে ঢলে পড়েছেন আবার বেদনার কোনো স্মৃতিতে আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুপাত করেছেন। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আমি তাঁকে মাহমুদ ভাই আর তিনি আমাকে ডাক্তার ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। আমার জানা মতে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে মাহমুদ ভাই ‘ডাক্তার ভাই, বলে সম্বোধন করতেন। আমাকে অনেকেই ডাক্তার ভাই বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু তাঁর সম্বোধনের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল তা সত্যিই বিরল।
মাহমুদ ভাইয়ের শেষ দিনগুলিতে সশরীরে তাঁর পাশে গিয়ে খবর নিতে পারিনি সত্যি কিন্তু সব সময় খবর রেখেছি। যে হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন সে হাসপাতালের সাথে আমার সম্পর্ক থাকায় কর্তৃপক্ষের সাথেও তাঁর চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলেছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেরা বহন করেছে সেখানেও আমার ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাভাষার এত বড় একজন কবির সাথে একজন চিকিৎসক এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সামান্য ভূমিকা রাখতে পারাও এক ধরনের সৌভাগ্য বলে আমার মনে হয়। সে হিসেবে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। কবি আল মাহমুদ তাঁর কালজয়ী সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন এটা আমার বিশ্বাস। এখন আমাদের উচিত হবে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর সাহিত্যের অনুবাদ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।