কবি আল মাহমুদ বাংলার সাহিত্যাকাশে ঐশী আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত এক ধ্রুবতারা। যিনি বাংলাদেশের গ্রামীণজীবন, সাধারণ মানুষের ভাষা, সুখ-দুঃখ এবং স্বদেশপ্রেমকে সার্থকভাবে তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ধ্রুবতারাকে আমি প্রথম দেখেছি ১৯৭৭-৭৮ সালে ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে। তখন বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারটি ছিল সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিপরীতে নিউ এলিফ্যান্ট রোডে। এখান থেকেই নিয়মিত প্রকাশ পেত মাসিক পৃথিবী ও সাহিত্য পত্রিকা মাসিক কলম। এখানে মাসিক সাহিত্য সভা হতো। এ সভায় যোগ দিতেন ড. কাজী দীন মুহম্মদ, কবি আল মাহমুদ, জুলফিকার আহমদ কিস্মতী এবং তরুণ কবি সাহিত্যিকগণ। সে সময় কবির প্রতিভা ও সুখ্যাতি সম্বন্ধে আমার তেমন ধারণা ছিল না। শুধু একজন কবি হিসেবে তাঁর বক্তব্য ও স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই সন্তুষ্ট থাকতাম। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আমি চট্টগ্রামে লেখাপড়ার জন্য চলে আসি। এখানে যুক্ত হই আদর্শে উজ্জীবিত একদল তরুণের সাথে। সাহিত্য চর্চায় পুরোপুরি মনোযোগ দেই। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে কবি ও কবিতার খোঁজ-খবর নিতে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দৈনিক কাগজসমূহের সাহিত্যপাতা, জনপ্রিয় সাহিত্য ম্যাগাজিন ঢাকা ডাইজেস্ট, নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক রোববার, পাক্ষিক পালাবদল প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত কবি আল মাহমুদের কবিতা গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করতে থাকি। আমাদের বন্ধুদের মাঝে তুমুল বিতর্ক হতো বর্তমান বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে? কবি শামসুর রাহমান না আল মাহমুদ! শামসুর রাহমানও ছিলেন বড় কবি। কবি আল মাহমুদ সাহিত্য বিচারে তার চেয়েও বড় কবি। সবচেয়ে বড় কথা কবি আল মাহমুদ একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যার অবদান অনন্য।

এ.এফ.এম. হাসান, ড. আহসান সাইয়েদ, ফেরদৌসুল কবির ও এস.এম. সোলায়মান
কবি আল মাহমুদের সাথে চট্টগ্রামের সম্পর্ক আশৈশব। তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আত্মজীবনীতে চট্টগ্রামের নানা স্মৃতি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। সৈয়দ আলী আহসানের বদান্যতায় চট্টগ্রামের বইঘরে তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ সসম্মানে চাকরি করেছেন। বইঘরের স্বত্বাধিকারী শফি সাহেব কবিকে খুব সম্মান করতেন। চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত গায়ক শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ছিলেন কবির প্রিয় বন্ধু। কিছুকাল তারা একই ভবনে বসবাস করতেন। চট্টগ্রামে রয়েছে কবির অনেক আপনজন। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রফেসর, কলেজের প্রিন্সিপাল, অধ্যাপক, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক ও তরুণ কবি-সাহিত্যিকগণ। তাঁরা প্রতিনিয়ত কবি আল মাহমুদকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে কবির সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে যাই বহুবার। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও স্নেহমাখা কথা আমাকে মুগ্ধ করে। এরপর থেকে ১১ জুলাই তাঁর শুভ জন্মদিনে প্রতি বছর শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতাম। ঢাকা গেলেই সুযোগ খুঁজতাম কখন, কোথায় কবির দেখা পাবো। বেশ কয়েকবার দৈনিক সংগ্রাম অফিসেও কবির সাথে সাক্ষাৎ করেছি। একবার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর তিনি একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখছিলেন। একটি ছোট্ট বিষয়ে আমার মতামতও চাইলেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এর কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের মুসলিম হলে একটি সেমিনার হয়েছিল। আমার যতটুকু স্মরণ ছিল, আমি সেই সেমিনারের সারসংক্ষেপ কবির কাছে তুলে ধরেছিলাম। তিনি খুশি হয়ে আমার অভিমতের কিছু অংশ ঐ লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেন।
নব্বই দশক পর্বে চট্টগ্রামের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্র সংসদে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রসংগঠন সমাসীন ছিল। ফলে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে, বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী সভায়, কোন নতুন বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতেন। ফলে কয়েক মাস পরপরই আমরা কবিকে কাছে পেতাম। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বহুবার এসেছেন।

কবি আল মাহমুদ যে কাব্যগ্রন্থটির জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন, সেই ‘সোনালী কাবিন’ এই চট্টগ্রামেই রচিত। সোনালী কাবিনের চৌদ্দটি সনেট কালজয়ী হিসেবে যুগ যুগ ধরে আবৃত্তিকারদের মুখে মুখে ফিরবে। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ শিশু-কিশোর ছড়া ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ এই চট্টগ্রামে রচিত। এর প্রথম ক’টি চরণ এরকম-
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিলো থরথর।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ?
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিলো আয় আয়।….
এই ছড়াটি একটি সচল চিত্রের মতো আমার হৃদয়ে ভাসমান। আমি কতবার এই ছড়াটি পড়তে পড়তে ছুটে গিয়েছি পাথরঘাটার গির্জা, শাহ্ আমানতের দরগাহ্, লালদীঘি, পরীর পাহাড় প্রভৃতি দেখতে। আর আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ এই চট্টগ্রামকে কত ভালোবাসতেন। তাঁর আরো অনেক লেখায় এই চট্টগ্রামের নানা চিত্র ফুটে উঠেছে।
একবারের কথা মনে পড়ে ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম কলেজের একটি প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে কবি এসেছিলেন। তিনি উঠেছিলেন তাঁর একনিষ্ঠ বন্ধু ব্যবসায়ী হাজী মুসা সাহেবের জামালখানস্থ বাসায়। মুসা সাহেব ছিলেন একটি আধুনিক অটোমেটিক লন্ড্রির মালিক। অত্যন্ত ধর্মভাবাপন্ন ও সাহিত্য সংস্কৃতির সমঝদার ব্যক্তি। লন্ড্রিটির নাম ছিল ‘শুচিতা লন্ড্রি’। কবি ঐ রাতে নানা গল্প-গুজবে বন্ধুর সাথে সময় কাটান। বন্ধুও হৃদয় উজাড় করে কবিকে আদর-আপ্যায়ন করেন। ঢাকা ফিরে তিনি ঢাকা ডাইজেস্টে একটি গল্পে শুচিতা লন্ড্রির মালিকের বাড়িতে কিভাবে আদর আপ্যায়নে আপ্লুত হয়েছিলেন তা বর্ণনা করেন। রাতে ঘুমানোর সময় একটি বিড়াল তাকে খুব বিরক্ত করছিলো। বিড়ালটিকে ধমক দিলে সে পালাতে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পাশের ড্রেনে। এই গল্পটি পড়ে তৎকালীন ছাত্র, পরে বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী প্রফেসর ডক্টর সালাহউদ্দীন আইয়ুব ছুটে আসে জামালখানে। তার প্রবল কৌতূহল কবি এই চট্টগ্রাম শহরে এই বাড়িতে কিভাবে রাত কাটিয়েছেন। তার দুঃখ আহা ঐ হুলো বিড়ালটি প্রিয় কবিকে একটুও শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি। সালাহউদ্দীন পুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঐ খরস্রোতা ড্রেনটি বারবার অবলোকন করছিলো।

চট্টগ্রামে কবি আল মাহমুদকে নানা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পদক ও সংবর্ধনা-সম্মাননা প্রদান করা হয়। তার মধ্যে বায়তুশ শরফ আন্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র ও ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ অন্যতম। এসব সংবর্ধনায় যতবারই তিনি আগমন করেছেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত কবির ভক্তকুল ছুটে এসেছেন কবিকে একনজর দেখার জন্য, কবির দুটো কথা শোনার জন্য, কবির স্বকণ্ঠে একটি কবিতার আবৃত্তি শোনার জন্য।
১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসে ১১ রবিউল আউয়াল জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহ্সানের সাথে কবি আল মাহমুদকেও বায়তুশ শরফে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। শাহ্ মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) তাঁর প্রিয় ভক্ত কবি আল মাহমুদের হাতে তুলে দেন একটি সোনালি হরফে লেখা ক্রেস্ট। বক্তৃতা দানের সময় আল মাহমুদ কাঁদতে কাঁদতে একেবারে বেহুঁশ অবস্থা। তাঁকে সবাই সান্ত¡না দিয়ে কান্না থামালেন। পরে আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আজকের এ আনন্দের মুহূর্তে কান্না কেন? তিনি ধীরস্থিরভাবে বললেন, জীবনে জেনে শুনে বা নিজের অজান্তে কতো গুনাহ্ করেছি, সেই গুনাহ্গার ব্যক্তিকে স্বীয় পীর নিজ হাতে ক্রেস্ট তুলে দিয়ে হাজার হাজার সুধীর সামনে তাঁকে সংবর্ধনা দিচ্ছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? আমি কি এর উপযুক্ত! এ কথা ভেবেই আমার বুক ফেটে অশ্রু নেমে এসেছে।
‘চিরসংগ্রামী কবি ফররুখ’ আমার লেখা বইটির পাণ্ডুলিপি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগে ছাপার জন্য জমা দিয়েছিলাম ১৯৮৪ সালে। বহু বছর পর খবর এলো বইটি ছাপার অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে। এ খুশির সংবাদ আমাকে আপ্লুত করেছে। আমি ঢাকা গেলেই বায়তুল মোকাররম ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিসে ঢু মারি। কখন বই বের হবে তা জানতে। ইতোমধ্যে আমার লেখা ‘ঈমান জাগার গল্প’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হওয়ায় প্রকাশনা বিভাগের অনেক কর্মকর্তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সখ্য জন্মে। দু’বছর পর প্রকাশনা কর্মকর্তা আমাকে হতাশ করে দিয়ে বললেন, ফান্ডের অভাবে আপনার বইটি এখান থেকে প্রকাশ করা যাবে না। আপনি চাইলে পাণ্ডুলিপি ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে বললেন, দেশের দু’জন বিখ্যাত কবি আপনার পাণ্ডুলিপিটি রিভিউ করেছেন। আমি তার দু’টি ফটোকপি আপনাকে দিচ্ছি। কোন প্রকাশক এটি পেলে দ্রুত বইটি ছাপাবে। তিনি যখন আমার হাতে রিভিউয়ের দু’টি ফটোকপি দিলেন, আমি তা দেখে ক্ষণিকের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। এর একটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক কবি আল মাহমুদ অন্যটি স্বহস্তে লেখা সব্যসাচী লেখক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের। আমার লেখা চিরসংগ্রামী কবি ফররুখ আহমদের জীবনীর পাণ্ডুলিপি এই দুই মহান কবির পক্ষ হতে ছাপার অনুমোদন সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে আমাকে আরও বিশ্বাসী করে তোলে। তাঁদের এ ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারিনি।
১৯৯৫ সালের ১ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কবি আল মাহমুদকে ‘ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার ১৯৯৫’ প্রদান করা হয়। এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহেদী। এই অনুষ্ঠানে কবিকে দেখার জন্য, তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য হলের ভেতরে ও বাইরে উপচে পড়া ভিড় লেগেছিল। মেহ্মানদের অনেক স্তুতিবাক্যে কবি আপ্লুত হলেন। সংবর্ধনার জবাবে কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘সুধীবৃন্দ, আমি মনে করি এ পুরস্কার আমার জন্য দরকার ছিল। আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি। পুরস্কারের তালিকা আমার জন্য ক্রমাগত সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ৮টি পুরস্কার আছে, সব পুরস্কারই পেয়ে গেছি। চট্টগ্রাম থেকে লিখিত ক্রেস্টে খোদিত এ পুরস্কারটি দরকার ছিল। কারণ আমার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম আমি চট্টগ্রামেই রচনা করেছি। ‘সোনালী কাবিন’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’ চট্টগ্রামেই লেখা। আজকে আমার আনন্দের দিন, আমি পুরস্কার পেয়েছি। সে জন্যে হয়তো কেউ দয়া করে, অনুগ্রহ করে, আমার প্রতি ভালোবাসাবশত সমালোচনা করেননি। কিন্তু আপনারা জানেন যারা সাহিত্যের খোঁজ-খবর রাখেন, আমি হলাম সেই ব্যক্তি, যাকে নানা সমালোচনায় প্রায় তিক্ত করে তোলা হয়েছে। মনে রাখবেন, নর-নারীর সম্বন্ধসূত্রই শুধু সাহিত্য নয়, দেশের মাটি, তার প্রকৃতি- সবটাই মিলিয়ে একটা দেশ, এই মাটি ও মানুষের কথা ফুটিয়ে তোলাই কবিতা, এর প্রকাশ ও বিকাশই সাহিত্য। আমি এ পুরস্কারে এ জন্য আনন্দিত, যাঁর নামাঙ্কিত এই পুরস্কার- কবি ফররুখ আহমদ, আমাদের সাহিত্যের সবচেয়ে মৌলিক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর।’

২০০৮ সালে থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামে কবি আল মাহমুদের ৭৩তম জন্মদিন উপলক্ষে এক বিশেষ সংবর্ধনা ও সাহিত্য সভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিজ্ঞানী ও কবি প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রের সভাপতি আমীরুল ইসলাম। সভাপতি অত্যন্ত সংক্ষেপে চট্টগ্রামে কবি আল মাহমুদ শীর্ষক তাঁর সারগর্ভ বক্তব্যে বলেন, ‘চট্টগ্রাম হচ্ছে কবির প্রিয় শহর, স্মৃতির শহর। এ শহরের সাথে রয়েছে তার নিবিড় সম্পর্ক। এ শহরে তিনি এসেছিলেন, অনেক দিন হয়ে গেল। তাই চট্টগ্রামের কবি ভক্তদের পক্ষ থেকে আজকের এ ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম যে কবি আল মাহমুদের জীবনের সাথে নানাভাবে জড়িয়ে, সে কথা সম্মানিত উপস্থিতির অনেকেই ভালো জানেন। এখানে রয়েছে তাঁর শিক্ষাজীবনের স্মৃতি, শিল্প সৃষ্টির স্মৃতি, এমনকি মানবিক সম্পর্ক, পেশাগত জীবন কিংবা ধর্মবোধের স্মৃতি। কৈশোরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। ষাটের দশকে তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও প্রথিতযশা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইঘরের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রকাশনা সহযোগী হিসেবে। ‘সোনালী কাবিন’ যাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অমর কাব্যগ্রন্থ- সে বইয়ের প্রসিদ্ধ সেই চৌদ্দটি সনেট রচিত হয়েছিল এই চট্টগ্রামেই। এ ছাড়াও তাঁর বিভিন্ন ছড়া-কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসে চট্টগ্রামের মাটি-মানুষ ও প্রকৃতির অনুষঙ্গ নানাভাবে চিত্রিত। মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন সম্পাদিত ‘উপমা- আল মাহমুদ সংখ্যার’ কথা বলা যায়, যা আল মাহমুদ প্রেমিকদের কাছে অনেকটা আকর গ্রন্থ। এ ছাড়াও রয়েছে ‘পূবাকাশ’ ও ‘ছড়া পত্রিকা’র বিশেষ সংখ্যা- যাতে প্রধানত কবির ওপর মূল্যায়নধর্মী নানা রচনা ও সৃজনশীল লেখালেখি রয়েছে। ‘পোয়েটিকস’ বের করেছে আল মাহমুদের কবিতার সিডি/ক্যাসেট। চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র হতে প্রকাশিত হয় কবির কাব্যগ্রন্থ ‘দোয়েল ও দয়িতা’। কেন্দ্রের সাহিত্যপত্র নোঙর পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় আল মাহমুদের কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে।’
কবি আল মাহমুদ সংবর্ধনার জবাবে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। তার মধ্য হতে শুধু দু’টি বাক্য এখানে উল্লেখ করছি। ‘এই শহরে, এই যে চট্টগ্রামে আমি কবিতা লিখার ভিখারি হয়ে ঢুকেছিলাম অনেকদিন আগে। আমিও ভুলে গেছি সেইসব দিন। সেই ঢুকেছিলাম, আর এইখান থেকে শিখে গিয়েছিলাম এমন অনেক বিষয়, যা পরবর্তীতে আমার সারাজীবনে কাজে লেগেছে।’
২০ জুন ২০১৫ চট্টগ্রাম বাতিঘরের কর্ণধার দীপংকর দা’র আমন্ত্রণে সর্বশেষ কবি আল মাহমুদ চট্টগ্রামে এসেছিলেন। বারবার খবর আসছে কবি অন্ধ হয়ে গিয়েছেন, বধির হয়ে গিয়েছেন, অচল হয়ে গিয়েছেন। এ অবস্থায় তিনি কিভাবে চট্টগ্রাম এসেছেন এ সংবাদে চারদিক আলোড়িত হয়ে পড়ে। সাহিত্যপ্রেমীরা ছুটে যায় কবি আল মাহমুদকে এক নজর দেখার জন্য বাতিঘরে। ঐ সময় কবির বয়স ৮০। দৈহিক নানা অক্ষমতা থাকলেও মানসিক সক্ষমতা ছিল অটুট। সংস্কৃতি কেন্দ্রের মুখপত্র ‘নোঙর’ পত্রিকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সাথে তিনি জিইসি মোড়ে হোটেল বোনানজায় এক প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে ওঠেন। উপস্থিত সাহিত্যকর্মীদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা শেষে কবি এ কথা বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন, ‘কবির কাজ কী? কবির কাজ হচ্ছে জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। আমি সেই চেষ্টাই করেছি। সাফল্য-অসাফল্য এটা কে নির্ধারণ করবে? সাহিত্যের বিচার হয় হাজার বছর পরে। আমি আশা করি, আমি যে কাজ করেছি সময় আমার প্রতি সুবিচার করবে। আপনাদের ধন্যবাদ।’
চট্টগ্রাম এলেই তিনি আমার খোঁজ-খবর নিতেন। শেষদিকে এসে তিনি আমার নাম ভুলে যেতেন। তখন চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র বা ফুলকুঁড়ির কোনো দায়িত্বশীলকে বলতেন, বায়তুশ শরফের ঐ ছেলেটি…. ঐ যে… ঐ সুন্দর ছেলেটিকে খবর দাও আমি চট্টগ্রাম এসেছি। তারা বলতো জাফর ভাইয়ের কথা বলছেন? দ্বীন দুনিয়া পত্রিকার সম্পাদক! হ্যাঁ। এ খবর পেয়ে আমি ছুটে যেতাম আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদের কাছে। ১৯৯৪ সালে বায়তুশ শরফ এলে আমি আধুনিক প্রকাশনী হতে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত শিল্পী সবিহ উল আলমের আঁকা প্রচ্ছদে, চট্টগ্রাম সিগনেট প্রেস হতে ছাপা ‘আল মাহমুদের কবিতা’ বইটি তাঁকে দেখালে উনি অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর সদ্য প্রকাশিত অনেক কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ বা উপন্যাস বাজার থেকে ক্রয় করে তাঁর কাছে নিয়ে যেতাম। উনি সুন্দর মন্তব্যসহ অটোগ্রাফ দিতেন। ১৯৮৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শাহ্ আবদুল জব্বারের ছেলে হাফেজ আবদুর রহীম আন্দরকিল্লায় ইসলামী ছাত্রসংগঠনের মিছিলের অগ্রভাবে থেকে শহীদ হলে কবি আল মাহমুদ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন। ঐ দিন রাতেই তিনি রচনা করেন ‘রক্তের বৃষ্টির পর’ নামে শাহাদতের এক অমর কবিতা। তাঁর কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন-
কে বলে নিহত এরা? পরাজিত মৃত্যুর পেছনে
আমি শুনি অবিশ্রাম ডানার আওয়াজ।
উড়ে যায় জোড় বাঁধা গুঞ্জন মুখর হরিয়াল।
উড়ে যায়
বেহেস্তের সবুজ ছায়ায়।
আবদুর রহীম কারো নাম নয়
যেন কোন রংধনু, রক্তের বৃষ্টির পর
আকাশ আকুল করে উঠে যায়
সীমাহীন নীলের নক্সায়।…
১৯৯৮ সালের ২৫ মার্চ বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহ্ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে কবি স্বীয় পীরের উদ্দেশ্যে যে শোকগাঁথা রচনা করেন, তাতে আল মাহমুদের আধ্যাত্মিক সাধনার গভীরতা প্রস্ফুটিত হয়েছে। দীর্ঘ কবিতার কিছু অংশ-
তাঁর মৃত্যু সংবাদে মনে হ্লো সততা ও সাহসিকতারই বুঝি অবসান হল।
পর মুহূর্তেই মনে হলো তা কি করে হবে?
তিনি তো ছিলেন ঈমান ও তৌহিদের নিশান। যা কিছু
ন্যায় ও সত্য সেসব নিয়ামত তার মুখ থেকে নির্ঝরের মত
নির্গত হয়ে আমাদের সিক্ত করে দিত। তিনি আমাকে
দু’টি মাত্র উপদেশ ঠিকমত মেনে চলতে শিখিয়েছিলেন।
এক, সিজদায় মাথা ঠেকিয়ে রাখার সময় রক্ত-মাংসসহ
নিজের ভেতরটাকে একেবারে উবুড় করে দেয়া।
দুই, কবির অহঙ্কার ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত ফেলে দিয়ে একেবারে
আল্লাহ্ প্রেমিকদের ভিড়ে ফতুর হয়ে মিশে যাওয়া।
আমি এর কোনটাই রপ্ত করতে পারছি না বুঝতে পেরে
তিনি আমার ব্যর্থ ও ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে
একটু হাসতেন।
তার হাসি ছিলো বেহেশ্ত থেকে বিচ্ছুরিত রোদের মত।…
২০০৫ সালের ১১ মার্চ একদিন দুপুর বেলা কবি সদলবলে ছুটে এসেছেন বায়তুশ শরফ। কিছুক্ষণ অবস্থান করেছেন অধ্যক্ষ মহোদয়ের কক্ষে। এরপর অধ্যক্ষ মহোদয় এবং শিক্ষকবৃন্দসহ শাহ্ আবদুল জব্বার (রহ.)-এর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ভক্তি নিয়ে জিয়ারত করেন। এরূপ প্রায় সময় চট্টগ্রামে এলে তিনি কাউকে না জানিয়ে বায়তুশ শরফে ছুটে আসতেন। তিনি দেশের যে প্রান্তেই অবস্থান করতেন না কেন চট্টগ্রামকে কখনো তাঁর হৃদয় থেকে মুছে ফেলেননি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার তাঁর ইন্তেকালের সংবাদে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিক কান্নায় ভেঙে পড়েন। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণ, পূর্বদেশ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম মঞ্চ প্রভৃতি এবং একসময় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক কর্ণফুলী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মৃত্যু সংবাদ, ঢাকায় বাংলা একাডেমির পক্ষ হতে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও বায়তুল মোকাররমে কবির জানাজা, পরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজ গ্রাম দক্ষিণ মোড়াইলে জানাজা ও দাফনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সপ্তাহে প্রতিটি পত্রিকার সাহিত্য সাপ্তাহিকীতে বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও স্মৃতিচারণ প্রকাশ পায়। তাঁর ইন্তেকালের এক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম হতে আমার সম্পাদনায় প্রকাশ করি শিশু-কিশোর দ্বীন দুনিয়া কবি আল মাহমুদ সংখ্যা। বেশ কয়েকটি সংগঠন কবির স্মৃতিস্মরণে সভা-সমাবেশের আয়োজন করে। এতে সকল মত ও পথের, ধর্ম ও বর্ণের সাহিত্যপ্রেমীগণ উপস্থিত ছিলেন।
২৬ এপ্রিল ২০১৯ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন মিলনায়তনে জনাব আমীরুল ইসলামের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম আল মাহমুদ স্মরণসভা উদ্যাপন কমিটি কর্তৃক ‘চট্টগ্রামের আল মাহমুদ আল মাহমুদের চট্টগ্রাম’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আল মাহমুদের প্রিয় বন্ধু কবিকণ্ঠ কবি আসাদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন কবির সাহিত্যকর্মের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত কবি ড. ফজলুল হক তুহিন। বক্তব্য রাখেন, অধ্যক্ষ ড. সাইয়েদ আবু নোমান, কবি নিযামুদ্দীন, কবি কমরুদ্দিন আহমদ, ক্বণন সভাপতি মোসতাক খন্দকার, কথাসাহিত্যিক ড. আহমেদ মাওলা, মাসিক দ্বীন দুনিয়া সম্পাদক মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্, কবি মাঈনুদ্দিন জাহেদ এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী আবু সাঈদ হান্নান। প্রধান অতিথি কবি আসাদ চৌধুরী অনেক স্মৃতিকথা ও আল মাহমুদের কাব্যসমগ্রের বিশালতা বর্ণনা করেন। পরিশেষে আসাদ চৌধুরী বলেন, ভারতের বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবনারায়ণ রায় এর বিখ্যাত উক্তি, ‘পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কবি আল মাহমুদ ছিলেন একজন জলজ্যান্ত কবি।’
চট্টগ্রামে কবি আল মাহমুদ কোনো উপলক্ষে আগমন করলে কে তার হোস্ট হবেন, কার বাড়িতে নিয়ে যাবেন, কবির পছন্দের খাবার খাওয়াবেন, এ নিয়ে হুলস্থূল পড়ে যেত। বিভিন্ন সময় কবি যাদের মেহমানদারিতে বেশি মুগ্ধ হয়েছেন তারা হলেন, পাঁচলাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আকবর খান, চট্টেশ্বরী রোডের বাসিন্দা শিল্পপতি মোহাম্মদ হারুন, বিশিষ্ট শিল্পী ও পাঞ্জেরীর সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দীন আহমদ সিএ, চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালক আমীরুল ইসলাম, বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ও ক্বণন সভাপতি মোসতাক খন্দকার, বিশিষ্ট ছড়াকার ডা. নাসির উদ্দীন প্রমুখ। এর বাইরেও হয়তো অনেকেই আছেন, সেই সম্মানিত মেজবানদের নাম আমি জানি না বলে দুঃখিত। হয়তো এ বিষয়ে অন্য কেউ ভবিষ্যতে লিখবেন।