সাততলা বাড়ির পঞ্চম তলায় তমালদের বাসা। এটা বনশ্রীর একটা শাখা রোড। বাসাটার সামনের দিকে দুটো এক চিলতে বারান্দা। এটাই তমালের আকাশ দেখার অলিন্দ। কত বাড়ির বারান্দার টবে ফুলের গাছ দেখেছে তমাল। হয়তো মানি প্লান্টের একটা লতা ঝুলছে অথবা ভর সন্ধ্যায় ফুটে আছে সন্ধ্যা মালতি। কিংবা অন্য কোন গাছ। গাছের পাতা দুলছে। দূর থেকে দেখে ভালোই লাগে। অবাক লাগে সন্ধ্যা মালতি। বিকেল থেকে ফুটতে শুরু করে, সন্ধ্যায় লাল হলুদ গোলাপি ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গাছটি। সন্ধ্যায় ফোটে বলেই এই নাম। সংক্ষিপ্ত নাম মালতি।
একবার তমালের ইচ্ছে করলো বারান্দায় ফুলের গাছ লাগাবে। আব্বুকে বলতেই তিনি লুফে নিলেন প্রস্তাব।
: বাহ, তাহলে তো ভালোই হয়। আমাদের বাসাও হয়ে উঠবে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি।
: অক্সিজেন ফ্যাক্টরি সেটা আবার কী আব্বু? প্রশ্ন তমালের।
: জানো না গাছ প্রকৃতিতে অক্সিজেন ছড়ায়। আর অক্সিজেনে শ্বাস নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। তাই গাছ মানে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি।
: হ্যাঁ আব্বু, আমাদের বইয়েও এ কথা আছে তো। খুশি হয়ে জবাব দেয় তমাল।
সব শুনে বাগড়া দিয়ে বসেন তমালের আম্মা।
: না না। বারান্দায় গাছটাছ লাগিয়ে কাজ নেই। কাপড় রোদে দেব কোথায়?
: উফ! আম্মুটা যে কি। তেতে ওঠে তমাল।
আব্বা বুঝিয়ে বলার পর মেজাজ ঠাণ্ডা হয় সাবিনার। ব্যাংকার স্বামী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সাবিনার ছোট্ট এক সংসার। আর পারুল নামে একটা কাজের মেয়েও আছে বটে। সেও তো সংসারেরই অংশ। তবে বছরে কয়েক বার নানা ছুতায় বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে যাওয়া চাই তার। তখন সাবিনাকে একাই সংসারের সব কাজ সামলাতে হয়। পারুল নেই, বাড়ি গেছে, মেজাজটা তাই খিটখিটে হয়ে আছে।
আর দুটো মাত্র ছোট ছোট বারান্দা। তাও সারাক্ষণ তো আর রোদ থাকে না। এখানে ফুলের টব থাকলে কাপড় মেলবে কোথায়?
ছেলে তমালকে কি তিনি কম ভালবাসেন? এসব কারণেই না বারণ করেছিলেন।
তবে তমালের বাবা শাহেদ সাহেব শর্ত দিয়ে দিয়েছেন, গাছের সংখ্যা যেন বেশি না হয়। কাপড় শুকানোর কোন অসুবিধা করা যাবে না।
একদিন আব্বুর সাথে শিশু একাডেমির সামনে থেকে টবসহ তিনটে গাছের চারা নিয়ে এলেন শাহেদ সাহেব। ছুটির দিন ছিল বলে তমালও গেছে সঙ্গে। গাছের চারা বলতে একটা সন্ধ্যা মালতি, একটা চায়না টগর ও একটা পাতা বাহারের চারা। মাঝামাঝি আকৃতির, আস্তে আস্তে বড় হবে। আম্মুকে খুশি করার জন্য আনলো একটা লেবু ও একটা মরিচের চারা। লেবু গাছে ছোট্ট একটা লেবু ঝুলছে, আছে কয়েকটা ফুল। আর মরিচ গাছে আছে কয়েকটি কালো কালো মরিচ।
এবার মায়ের মুখে হাসি ফুটলো। এগুলো দেখে তমালের ছোট বোন তিন বছরের নিপাও যেন খুশি।
গাছগুলো দুটো বারান্দাতে ভাগ করে রাখা হলো যাতে লাইলী বুয়ার কাপড় মেলতে কোন অসুবিধা না হয়। সে ঠিকে কাজের বুয়া। সকাল ও দুপুরে দুই বেলা কাজ করে দিয়ে যায়। পারুল না আসা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চলবে।
দেখতে দেখতে গাছগুলো লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। তেলের ক্যান কেটে টব বানিয়ে ওতেও তমাল লাগায় এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে আনা বট পাকুড় আর মানি প্লান্টের চারা। তার পর আনলো তেঁতুল চারা। এগুলো এমনি এমনি পাওয়া যায়, রাস্তার পাশে বা দেয়ালের ফাঁক-ফোকরে জন্মে। গোড়াসহ তুলে এনে টবে লাগালেই হলো। তমাল পত্রিকায় পড়ে জেনেছে টবে বনসাই করা যায়। তারও ইচ্ছে বনসাই বানানো।
দু’পাশের দুটি বারান্দায় খুদে বাগান। দেখতে ভালোই লাগে। বাসায় যারাই আসে তমাল আর নিপা ডেকে দেখায়। সবাই প্রশংসা করে।
জাহাঙ্গীর আংকেল তো বলেই বসলেন
: বাহ, ভাবী আপনাদের বাগানটা তো বেশ হয়েছে। দু-একটা গাছ সবুজ পাতা থাকলে তো ভালোই লাগে। জাহাঙ্গীর সাহেব তিন তলায় থাকেন। কী কাজে যেন তমালের আব্বুর কাছে এসেছেন।
তার কথা শুনে তমাল লজ্জা পায়।
: না আংকেল তেমন কী? অনেকের কত গাছ। আর আম্মু মুখ টিপে টিপে হাসেন।
: লেবু গাছটাতো বেশ বড় হয়েছে। বাহ ধরেছেও কয়েকটা। তেঁতুলের বনসাইও আছে দেখছি। ভাবী, তমাল তো একটা কাজের কাজ করেছে। তমালের আম্মাকে উদ্দেশ করে বলেন তিনি। কি সব কাগজপত্র নিয়ে বসেছেন শাহেদ সাহেব। তার এদিকে নজর নেই।
রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন তমালের আম্মা।
: আর বলবেন না ভাই। ওর যন্ত্রণায় বারান্দায় কাপড় মেলতে পারি না। একটু দাঁড়াতে পারি না।
: কি যে বলেন, কত সুন্দর লাগছে। দেখেন দেখেন।
তাদের কথার মাঝখানে এসে ঢোকেন তমালের আব্বা।
: আর বলবেন না, এ নিয়ে ঝামেলায় আছি।
কি সব কথা বলে জাহাঙ্গীর সাহেব চা বিস্কুট খেয়ে চলে গেলেন একটু পর।
কিছুদিন পর শাহেদ সাহেব বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখার উপযোগী আরো কিছু লতানো গাছ এনে দিলেন। এখন বারান্দার শোভা আরো বেড়েছে।
এরই মাঝে চট্টগ্রাম থেকে এলেন শাহেদ সাহেবের বন্ধু শফিউল আলম সাহেব। তিনিও ভারি মুগ্ধ তমালের বাগান দেখে।
: বাহ মরিচ গাছে তো অজস্র মরিচ ধরেছে। ভাবী ভাবী, আপনাদের তো আর বাজার থেকে মরিচ কিনতে হবে না।
শুনে তমালের আম্মু হাসেন। কিছু বলেন না।
বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে অনেকেই দেখতে আসে তমালের বাগান। এবার মন কিছুটা নরম হয় সাবিনার। সাবিনা আর তার মেয়ে নিপা দু’জনে ক্ষণে ক্ষণে শুকনো হয়ে যাওয়া গাছের গোড়ায় পানি দেয়। মায়ের মনোভাবে পরিবর্তনে তমাল খুশি।
আর এখন ভোরবেলা বারান্দাতে পাখিও আসে। পরপর কয়েক দিন দু’ তিনটে চড়ুইকে দেখলো তমাল। বাবা-মাকে বলতে তারাও খুশি ।
: তাই নাকি! আমাদের বারান্দায় পাখিও আসে? অবাক হয়ে বলেন তমালের আব্বা।
এরপর একদিন সন্ধ্যায় এলো একটি দোয়েল। এ গাছ ও গাছ করে তার পর ফুড়ুত। আনন্দ আর ধরে না তমালের।