প্রিয় কিশোর ভাই-বোনেরা! আসসালামু আলাইকুম। আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে যাচ্ছে। প্রিয় পত্রিকা ‘কিশোরকণ্ঠের’ মাধ্যমে তোমাদের সাথে আমাদের এ সেতুবন্ধ রচনা হয়েছে। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এ পত্রিকা-পরিবারের প্রতি, যারা আমাদের এ যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দিলো। প্রিয় বন্ধুরা, গত সংখ্যায় আমারা স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসার শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হওয়া নিয়ে কথা বলেছি। এবার আমাদের কী করতে হবে বলতে পারো? আমরা শিক্ষক, ক্লাসরুম ও পরিবেশ সব কিছু ঠিকমত পেয়েছি, তাহলে আর কী বাকি আছে? সেটাই আজ তোমাদের সাথে শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ।
সে বিষয়ে আসার পূর্বে ছোট্ট একটা কৌতুক বলি। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে প্রশ্ন করছে, আগামীকালতো পরীক্ষা। কেমন প্রস্তুতি নিয়েছিস? দ্বিতীয় বন্ধু উত্তরে বললো, ‘খুব ভালো’। প্রথম বন্ধু বললো, কেমন ভালো? দ্বিতীয় বন্ধুর উত্তর- ‘বাবা বাজার থেকে ভালো কলম, পেন্সিল, মার্কার, পরিধানের জন্য জামা-জুতা সব এনেছেন। তো প্রস্তুতি খুব ভালো। দ্বিতীয় বন্ধুর পরবর্তী প্রশ্ন ‘তো পড়াশুনা?’ প্রথম বন্ধুর উত্তর ‘আরে দোস্ত! শুধু ঐটাই একটু কম করেছি!’
বন্ধুরা তোমরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছো আজকের বিষয় হবে ‘বাসায় বা বাড়িতে বসে তোমার অধ্যয়ন কিভাবে হবে’ সে ব্যাপারে। কেননা ক্লাসে শিক্ষকগণ যত ভালো করে বুঝিয়ে দিন আর তুমি যদি বাসায় এসে সে বিষয়কে ভালো করে আত্মস্থ না কর, তাহলে অবশ্যই ঐ পরীক্ষার্থীর মত হবে। সুতরাং ক্লাস শেষ হলে, পরবর্তী ক্লাসের আগে তোমাকে খুব ভালো করে পেছনের পড়াটা শেষ করে যেতে হবে।
বন্ধুরা, যারা ভালো পড়াশুনা করে তাদের মর্যাদা অনেক। মহান আল্লাহ আল-কুরআনে সর্বপ্রথম যে পাঁচ আয়াত নাযিল করেছেন, তা অধ্যয়ন সংক্রান্ত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য রাস্তায় বের হয়, তার জন্য মহান আল্লাহ জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ করে দেন। সুতরাং যতক্ষণ তোমরা জ্ঞান অর্জনে নিয়োজিত ততক্ষণ তুমি মহান আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর সুমহান বাণীর সাথেই সময় পার করছো। অতএব আমরা কখনোই আল্লাহ এবং রাসূল সা:-এর সাথে থাকার এ সুযোগ হাতছাড়া করবো না।
প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী বন্ধুরা, তাহলে স্কুল শেষে বাসায় বা বাড়িতে গিয়ে মাগরিব পর্যন্ত তোমার খেলাধুলা ও আনন্দ করে কাটানোর সুযোগ থাকবে। সবার জন্য এটা না-ও থাকতে পারে। যারা অনেক কষ্ট করে জীবিকা অর্জন করেন তাদের জন্য বিনোদনের সময় যেন সোনার হরিণ! সে যাই হোক, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে পড়াগুলো পুনরায় ঠিক করে নেবে এবং পরবর্তী দিনের ক্লাসের জন্য কী কী প্রস্তুতি গ্রহণ করবে তা ঠিক করতে থাকে। চলমান দিনের ক্লাসের পাঠ ঠিক করা এবং পরবর্তী দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্রে বাসায় বসে তোমরা কিভাবে অধ্যয়ন করতে পারো তার কিছু কৌশল নিম্নরূপ হতে পারে :
মূল বই (টেক্সট বুক) যথাযথ অধ্যয়ন করা। প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একটি নির্ধারিত বই নির্দিষ্ট করা থাকে। শিক্ষক সেই বই ফলো করেন এবং তার সাথে আরো কিছু যোগ করেন। সুতরাং মূল কাজ হবে বাসায় গিয়ে ঐ বই থেকে নির্ধারিত স্থান পড়া, বুঝতে চেষ্টা করা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে দাগ দেয়া।
প্রত্যেক বিষয়ের জন্য দু’টি খাতা রেডি করা। ক্লাসে বসে স্যারের নির্দেশনা এবং লেকচার সাঙ্কেতিক অথবা বিস্তারিতভাবে লিখে নিয়ে বাসায় এসে মূল বই এবং শিক্ষকপ্রদত্ত লেকচার মিলিয়ে খুব ফ্রেশ করে বাসার খাতায় তা লিপিবদ্ধ করা।
বাসার খাতায় ফ্রেশ করে লেখা হলে খুব মনোযোগ সহকারে পাঠ করা এবং প্রয়োজনীয় বিশেষ লাইন বা অংশ মনে রাখার চেষ্টা করা বা মুখস্থ করে ফেলা।
বাসায় বসে যে উত্তরটি ফাইনাল হয়ে গেলো সেটা কয়েকবার পড়ার পর একবার লেখা। তুমি দেখবে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নটি তোমার কাছে খুব স্পষ্ট এবং সহজ হয়ে গেছে। এ জন্য বলা হয় ‘কাগজ, কলম, মন/ লেখে তিনজন’। এ তিনের সমন্বয় হলে তোমার পরবর্তী সময়ের পড়াশুনায় মনোযোগ আসবে এবং খুব ভালো লাগবে।
যে বিষয়কে এভাবে গুছিয়ে নিয়েছো, সে সময় একই বই থেকে পরবর্তী দিনের পাঠ কী হতে পারে তা একবার চোখ বুলিয়ে যাওয়া। সেটা করতে পারলে তুমি অনেক এগিয়ে থাকলে এবং শিক্ষক যখন পড়াবেন তখন তোমার কাছে খুব সহজ এবং অধিক বোধগম্য হবে।
বাসায় আসার পর প্রতিটি সাবজেক্ট প্রাগুক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত করতে হবে।
অতঃপর প্রতিটি বিষয়কে ৩R পদ্ধতি প্রয়োগ করে পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। থ্রি আর পদ্ধতি হলো Read (পড়া), Recite (আবৃত্তি করা), Review (পুনরায় স্মরণ করা)।
বন্ধুরা
এর পরও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সেগুলো কোন সিনিয়র ভাইয়া, আপু অথবা টিচারের নিকট থেকে সমাধান করতে হবে। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যে সমস্যার মুখোমুখি হবে, তা অবশ্যই খাতায় লিখে ফেলবে। এবং সমাধান খুঁজে নেবে।
প্রতিকূল পরিবেশে অধ্যয়ন কৌশল
সবার মেধা মনন এক রকম নয়। সবার সব সময় একই ধারার লেখাপড়া হয় না। সে ক্ষেত্রে তোমাদের নিজেদের অভ্যাস প্রয়োগ করবে। যে যেভাবে পার তার অধ্যয়ন কৌশল নির্ধারণ করবে, যাতে করে জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারো। প্রিয় বন্ধুরা! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অধিকাংশ মানুষের জীবন অনেক সংগ্রামমুখর। সফলতার জন্য কেউ পথ রচনা করে দেয়নি, ব্যক্তিকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। সুতরাং তোমরা যারা মনে করো, তোমার অধ্যয়নের জন্য বাসায় অনেক সমস্যা রয়েছে যেমন- চেয়ার টেবিল কম, তা শেয়ার করতে হয়; বিদ্যুৎ নেই অথবা বিদ্যুৎ চলে যায়, বিকল্প আলোর ব্যবস্থা নেই; হয়তো পরিবারে অনেক ভাই-বোন সুযোগ পাওয়া যায় না; অথবা ভাই-বোন খুবই ছোট, তারা সবসময় অধ্যয়নে বাধা সৃষ্টি করে; পর্যাপ্ত খাবার স্বল্পতা, অধ্যয়ন সামগ্রীর অভাব ইত্যাদি হাজার রকম সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তোমার যদি অদম্য সাহস, আগ্রহ এবং আশা থাকে এসব কোন সমস্যাই তোমাকে আটকাতে পারবে না। যেমন ধরো ‘আলো নেই তুমি দিনের বেলা সময় কাজে লাগাবে, তোমার আলাদা টেবিল চেয়ার নেই তুমি খাটে অথবা মাটিতে বসে পড়বে, তোমার অনেক ভাইবোন একটু আওয়াজ করে পড়বে, তোমার ছোট ভাইবোন ডিস্টার্ব করে, তারা ঘুমালেই তুমি পড়বে। অথবা মনে থাকে না বা মুখস্থ হয় না একটু ভোর রাত্রে উঠে অধ্যয়ন করো ইনশাআল্লাহ মুখস্থ হবে। মোট কথা তোমাকেই তোমার পথ খুঁজে বের করতে হবে, তোমাকেই তোমার পরিবেশ ঠিক করতে হবে, তবেই তুমি হবে জগদ্বিখ্যাত।
যা করা উচিত নয়
প্রিয় বন্ধুরা! তোমাদের মেধা অত্যন্ত প্রখর। তোমরা বসন্তের বৃষ্টিস্নাত সবুজ সতেজ বৃক্ষের ন্যায়। যা চাইবে তা করতে পারবে। যদি পড়তে ইচ্ছা করো তাহলে যেমন কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারবে না, তেমনি যদি না চাও কেউ তোমাকে জোর করে পড়াতে পারবে না। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাই বাসায় অধ্যয়ন করা বা না করার জন্য যথেষ্ট। তারপরও বাড়িতে ভালো করে লেখাপড়া করার জন্য যে সকল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে তা হচ্ছে :
ক. নিয়ম লঙ্ঘন করা যাবে না। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মের আলোকে তোমার সকাল ও সন্ধ্যা হবে। তুমি রাত্রে সঠিক নিয়মে খাবে, ঘুমাবে। আবার সকালে যথাসময়ে উঠবে এবং নিয়মিত যা করা উচিত তা করবে।
খ. অপ্রয়োজনে ফেসবুক বা ইন্টারনেটে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা।
গ. সন্ধ্যার পর অধ্যয়নের সময় অন্যের সাথে সরাসরি বা মোবাইলে গল্প করা।
ঘ. রাত করে বাসায় আসা।
ঙ. গান শোনা, নাটক বা সিনেমা দেখা অথবা বন্ধুদের ডেকে এনে হই-হুল্লোড় করা।
চ. বাসার মানুষদের সাথে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা।
ছ. কোন দাবি পূরণ না হওয়ায় মুখ গোমড়া করে বসে থাকা।
জ. বাবা-মাকে কোন অসাধ্য কাজ করতে বাধ্য করা এবং তাদের মনে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পাওয়া।
ঝ. কোন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করা।
ঞ. মাত্রাতিরিক্ত খেলাধুলা করা বা দেখা।
চ. ধর্মীয় বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা।
প্রিয় কিশোর ভাই-বোনেরা, তোমার জীবন তোমাকেই সাজাতে হবে। তোমার সুন্দর আগামী তোমাকেই বিনির্মাণ করতে হবে। কোন অভিযোগ অনুযোগ না করে তোমার মাঝে মহান আল্লাহ যে অসীম শক্তি এবং ক্ষমতা প্রদান করেছেন তা ব্যবহার করে দুনিয়া এবং আখিরাতের সফলতা অর্জনের জন্য এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো। মহান আল্লাহ তোমাদের সবার জীবনকে কল্পনার অধিক সুন্দর করে দিন- এ প্রত্যাশা করছি।