Home সম্পূর্ণ কিশোর উপন্যাস নাবিলের টাইমমেশিন -হারুন ইবনে শাহাদাত

নাবিলের টাইমমেশিন -হারুন ইবনে শাহাদাত

[গত সংখ্যার পর]

৮.
আহ! কী সুন্দর কল কল শব্দে বয়ে যাচ্ছে নদী। না এটি নদী নয় নদ। নাবিল ভাবে নদ আর নদীর এই পার্থক্যের কারণ কী? সে এর সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তার মনের ভাবনাগুলো বুঝতে পেরে নাবিলের ঘোড়া ডাক দেয় : নাবিল!
নাবিল চমকে উঠে বলে : কী ডাকছো কেন?
: তুমি ভাবছো পাহাড়-পর্বতের কোল থেকে নেমে আসা, কুল কুল স্রোতধারার কোনটির নাম নদী আর আবার কোনটির নাম নদ কেন, তাই তো?
: হ্যাঁ, তাই এর উত্তর তোমার জানা আছে?
: পৃথিবীতে এই ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও আর অনেক নদ আছে যেমন, সিন্ধু নদ, নীল নদ…
: আমি তোমাকে যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও ঘ্যান-ঘ্যান বন্ধ করো।
: নাবিল তুমি কিন্তু শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছো, তোমার কথার উত্তরই তো আমি দিচ্ছি।
: তাই দাও, পৃথিবীতে কয়টি নদ আছে, নদী আছে তা কি আমি জানতে চেয়েছি না কি? আমি জানতে চাই নদ, নদী …
: আমি বলছি শোন সিন্ধু কিংবা নীল কেন নদ আমি জানি না, তবে ব্রহ্মপুত্রকে কেন নদ বলে তা জানি।
: ঠিক আছে তাই বলো।
: সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের অর্থ হচ্ছে ব্রহ্মার পুত্র।
: মানে হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের দেবতা ব্রহ্মা।
: ঠিক ধরেছো।
: তারা যেহেতু বিশ্বাস করে এটি তাদের দেবতা ব্রহ্মার পুত্র, তাই এই নদীর সাথে স্ত্রীলিঙ্গ বাচক নদী শব্দ ব্যবহার না করে নদ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
: তাহলে এই কাহিনী।
: হ্যাঁ, তবে কাহিনী আরো আছে, শুনবে না কি?
: অবশ্যই শুনবো?
: তবে শোন, ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের কাছে জিমা ইয়ংজং হিমবাহে যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। সাং পো নামে তিব্বতের পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে তখন এর নাম হয়ে যায় সিয়ং। তারপর আসামের ওপর দিয়ে দিহং নামে বয়ে যাওয়ার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরও দু’টি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র।
: খুব মজা তো, তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসী এবং আসামের পাহাড়িরা তাদের বিশ্বাসের আলোকে নিজেদের দেয়া নামে ডাকে? তাদের কাছে এটি নদী, সমতলে এসে আরো দুই নদীর মিলনে আকারে বড় হয়ে একেবারে নারী থেকে নর মানে নদী হলো নদ।
: তারপর শোন আরো মজার কাহিনী।
: আরে এত ভণিতা না করে বলে যাও।
: তাই বলছি, এই ব্রহ্মপুত্র নদটি ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের বাহাদুরাবাদ দিয়ে শুরু হয়ে তিব্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের মধ্যে চলে গেছে। হিমালয়ের মধ্য দিয়ে আসাম উপত্যকা হয়ে আবার বাংলাদেশে। এক হাজার ৮০০ মাইল দীর্ঘ। বেশির ভাগ জলসেচনের জন্য ব্যবহার করা হয়। যখন নদীটির অধিকাংশ ব্যবহার উপযোগী হয় ঠিক তখনই বন্যা বিপর্যয়ের জন্য দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে যায়। এ নদী জোয়ার-ভাটার আশ্রয়কেন্দ্র নামেও পরিচিত। মানে সমুদ্র থেকে আসা জোয়ার-ভাটা নদীটির জলস্রোতের গতিপথের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। গবেষকরা একে সত্য সামুদ্রিক তরঙ্গ বলেছেন। এককালের প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ এখন শীর্ণকায়। তিব্বতের কৈলাস পর্বতের হিমশীতল জলপ্রপাত, মানস সরোবরের নীলপদ্ম বিধৌত জলরাশি ও চেমাইয়াং ডং হিমবাহের স্রোতে সৃষ্ট প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্রের আদি রূপের বিবরণ এখন শুধু ইতিহাসের পাতাতেই পাবে। ব্রহ্মপুত্র মানচিত্র থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী শুনে কষ্টের নোনাজলে ভরে যায় নাবিলের দুই চোখ।

৯.
নাবিলের ঘোড়া ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে ছুটে চলছে। ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা নিচে সোনালি ধানের ক্ষেত। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় নাবিলের গা শির শির করছে। আবহাওয়ার এই রূপবদল শুধু ওর শরীর নয় মনে ধাক্কা দেয়। নাবিলের মনে পড়ে যায়, ষড়ঋতুর এই দেশে শরতের পালা শেষে হেমন্তের আগমনবার্তার কথা। নিচের দিকে দেখে মাঠে মাঠে সোনালি ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক। কৃষাণিরা ব্যস্ত মাড়াই করা ধান গোছানো আর পিঠা তৈরির কাজে। নাবিলের খুব ইচ্ছে জাগে এই নবান্ন উৎসবে যোগ দিয়ে নতুন চালের গরম ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েস খেতে। কিন্তু ওর হাতে সেই সময় কোথায়? সে এখন মহাকালের যাত্রী। শুধু নয় সময়ের সীমানাও তাকে পাড়ি দিতে হচ্ছে।
নাবিলের এবারের অভিযান ব্রহ্মপুত্রের ওপারের জেলা নেত্রকোনা।
: ‘কী ব্যাপার নাবিল চুপচাপ কেন?’ ঘোড়া জানতে চায়।
‘শীত শীত লাগছে।’ নাবিল উত্তর দেয়।
‘শীতের আগামবার্তা নিয়ে হেমন্ত এসেছে, এ তারই হিম হিম ছোঁয়া।’ হাসতে হাসতে বলে ঘোড়া।
‘বুঝলাম। এবার আমাকে বল, নেত্রকোনায় আমাকে কী দেখাবে?’ নাবিল জানতে চায়।
নাবিলের ঘোড়া এবার বিজ্ঞের মতো গম্ভীর ভাব নিয়ে শুরু করে, ‘ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে গারো পাহাড়ের কোলে নেত্রকোনা জেলার অবস্থান। কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, ঘোড়াউত্রা নদীবিধৌত নেত্রকোনা জেলা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণের অধীন ছিল। সমুদ্রগুপ্তের কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো নেত্রকোনাসহ ময়মনসিংহের পশ্চিমাংশ।’
নাবিল বলে, ‘সমুদ্র গুপ্তের সাম্রাজ্য তো উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নর্মদা তীর পর্যন্ত ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পশ্চিমে চম্বল ও যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা তার অধীন না হলেও কর দিতেন। তার বিজয় নীতির ফলে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব, রহিলখন্ড, পূর্ব মালবের কিছু অংশও তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তা ছাড়া সমতট (পূর্ববঙ্গ), দাবাক (সম্ভবত আসামের নওগাঁও), কামরূপ, নেপাল, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর প্রভৃতি উপজাতিরাও তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন ।’
‘তুমি তো আরো অনেক কিছু জান।’ ঘোড়া বলল।
‘ইতিহাস বইয়ে পড়েছি।’
নাবিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার ঘোড়া বলে, ‘আর কী পড়েছো বলো তো?’
নাবিল আবার শুরু করে, ‘৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুরাজ শশাংকের আমন্ত্রণে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ যখন কামরূপ অঞ্চলে আসেন, তখন পর্যন্ত নারায়ণ বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভাস্কর বর্মণ কামরূপ রাজ্যের রাজা ছিলেন।’
: হ্যাঁ তিনি রাজা সমুদ্রগুপ্তের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করেছেন।
: খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরাংশে পাহার মুল্লুকে বৈশ্যগারো ও দুর্গাগারো তাদের রাজত্ব পরিচালনা করতো। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মুসলিম রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহর উত্তরাধিকারীরা ময়মনসিংহ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। ময়মনসিংহের উত্তরাংশ কোচদের পুনরাধীন হয়ে পড়ে।
মোগল শাসনামলে রাজধানী দিল্লি থেকে অনেক দূরে ও কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে প্রধান রাজস্ব সচিব দেওয়ান সুলায়মান খাঁ (যিনি পূর্বে কালিদাস গজদানী নামে পরিচিত ছিলেন) কেন্দ্রর বিরুদ্ধাচরণ করেন। কেন্দ্রীয় শাসকের প্রেরিত সৈন্যদের হাতে সোলায়মান খাঁ নিহত হলেও তার দুই পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশা খাঁ খিজিরপুর থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ঈসা খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খাঁ ও আফগান সেনা খাজা উসমান খাঁ কর্তৃক অত্রাঞ্চল শাসিত ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
মোগল সেনাদের যুদ্ধকৌশলজনিত কারণে অনেক দুর্গ প্রতিষ্ঠা হয়। এ ছাড়া পূর্ববর্তী শাসকদের তৈরি ভাঙা দুর্গও তারা সংস্কার সাধন করে ব্যবহার করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোয়াই বাড়ি দুর্গ যা পরবর্তীকালে ঈসা খাঁর পারিষদ মজিদ জালাল এর আবাস বাটী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নেত্রকোনা জেলায় অনেক প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে। সে সকল স্থাপত্যগুলো অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। কিছু স্থাপত্য এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। নেত্রকোনার ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মদনপুরের হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রহ) মাজার, শাহ্ সুখুল আম্বিয়া মাজারের পাশে মোগল যুগের এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ, পুকুরিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ, নাটেরকোনার ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতের স্মৃতিচিহ্ন, দুর্গাপুর মাসকান্দা গ্রামের সুলতানি যুগের এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ।
নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, বন-জঙ্গলের জনপদ ছিল সমগ্র নেত্রকোনা। লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষকদের মতে পূর্ব ময়মনসিংহ হলো লোক ও সাহিত্য সংস্কৃতির এক তীর্থ ভূমি। নেত্রকোনার সন্তান চন্দ্র কুমার দে সংগৃহীত এবং ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পর থেকে পূর্ব ময়মনসিংহকে অনেক গবেষক মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চল বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। এই মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করা হয়-উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে মেঘনা, যমুনা সঙ্গমস্থল, পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পূর্বে সুরমা কুশিয়ারা নদী। এই মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের লোকসাহিত্য সংস্কৃতি, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো নেত্রকোনা।
১০.
নাবিলের ঘোড়া কখনো ছুটছে, কখনো উড়ছে। শুধু টগবগ আওয়াজ নয়। শোঁ শোঁ শব্দ করে সময়ের সীমানাও পাড়ি দিচ্ছে। পাড়ি দিচ্ছে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের সীমানা। মজার এই ভ্রমণে তার সাথে দেখা হচ্ছে ইতিহাসের পাতাজুড়ে থাকা রাজা, বাদশাহ, সম্রাট, সুলতান, যোদ্ধা, পীর-দরবেশ আর পর্যটকদের সাথে। ইতিহাসের পাতায় পড়া মানুষদের সাথে বাস্তবের এই দেখা সাক্ষাতের মজায় খুশিতে ভরে আছে নাবিলের মন। গৌড়, পান্ডুয়া, লক্ষ্মণাবতীর আকাশের সীমানা পেরিয়ে ঘোড়া ছুটছে সোনার গাঁয়ের পথে। নিচে সবুজ গ্রাম, সমৃদ্ধ নগর বন্দর, গঙ্গা, মহানন্দা নদী আর নাম না জানা কত শত সীমানা যে পাড়ি দিচ্ছে তা সে নিজেও জানে না।
আরে! শীতল বাতাসের ছোঁয়া কোথা থেকে আসছে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নাবিল। চিঁ-হি-চিঁ-হি করে হেসে ওঠে তার ঘোড়া।
ঘোড়ার এই স্বভাব ওর ভালো লাগে না। তার মনের কথা শুনে হঠাৎ করে হেসে ওঠে। এতে নাবিলের পিলে চমকে যায়। সে ব্যাপারটি বার বার বুঝিয়ে বলার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। সে মনে মনে ভাবে, আরে কাজ হবে কিভাবে? ঘোড়া কি আর মানুষ নাকি? আজ কাল মানুষগুলোরই যা অবস্থা, আর তো ঘোড়া। নাবিলের রাগ পানি হয়ে যায়।
ঘোড়া বলে, ‘ঠিক ভেবেছো। এই যে দেখো চার-পাঁচ বছর আগে এই শীতলক্ষ্যার বাতাসে কেমন মন জুড়িয়ে যেতো।’
‘বুঝলাম। শীতল বাতাসের এ ছোঁয়া পাচ্ছি, শীতলক্ষ্যা হতে।’ নাবিলে বলে।
‘হ্যা। ঠিক, তাই। কিন্তু এখন যদি তোমাকে বর্তমানে নিয়ে আসি, কেমন গন্ধ পাবে বলো?’
ঘোড়ার কথা শুনে শীতলক্ষ্যার বর্তমান অবস্থার কথা ভাবার সাথে সাথে একটা বাজে গন্ধ এসে নাবিলের নাকে ধাক্কা দেয়। সে, ‘ওয়াক থু’ শব্দ করে ওঠে।
‘শীতলক্ষ্যার এ অবস্থার জন্য দায়ী কে, আমরা নাকি তোমরা মানুষেরা?’ ঘোড়া বলে।
নাবিলের আর কথা বলতে ইচ্ছ করছে না। সোনারগাঁয়ের নাম শুনেই তার আবারও ইচ্ছে করছে বার ভূঁইয়া ঈসা খাঁর সাথে দেখা করতে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ের সাথে জড়িয়ে আছে ঈসা খাঁর নাম। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার প্রথম একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। স্বাধীন সুলতানি আমলে দেশের রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে। ১৩৫২ সালে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করেন এবং এখান থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। ঈসা খান ও তার বংশধরদের শাসনামলেও এই সমৃদ্ধ সোনারগাঁওই তাদের রাজধানী ছিল। ১৬১১ সালে মুসা খানের পতনের পর সোনারগাঁও মুগল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পর থেকেই দ্রুত সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব কমতে থাকে।
খুব নিচু দিয়ে ওড়ে যাচ্ছে নাবিলের ঘোড়া। এ ঘোড়া এখন পাড়ি দিচ্ছে মধ্যযুগ। নাবিলের চোখ আটকে গেলো ঐতিহ্যবাহী পানাম নগরীর সৌন্দর্যে। নাবিলের ঘোড়া আস্তে আস্তে নিচে নামছে। সবুজ ঘাসের গালিচা স্পর্শ করার পর নাবিল ঘোড়া থেকে নামলো। সামনের লোকটিকে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকায়। তার চোখ তো ছানাবড়া। নাবিল তাকে প্রশ্ন করেÑ
‘আপনি কে? আপনাকে তো এ দেশের বলে মনে হয় না। চেনা চেনা লাগছে, তবে নামটা…’
‘ঠিক মনে পড়ছে না। তাই তো?’ মুচকি হেসে বিদেশী বলেন।
‘হ্যাঁ ঠিক, তাই?’
‘আমার দেশ মরক্কো। নাম ইবনে বতুতা। তুমি এখন আছো ১৩৪৬ সালে।’
নাবিল বলল, ‘এবার চিনতে পারলাম। কেমন লাগছে বাংলাদেশ?’
‘সবেমাত্র এ বিখ্যাত বন্দর সোনারগাঁয়ে এসে নামলাম। ঘুরে দেখি তারপর বলব, কেমন লাগলো।’
‘শীতলক্ষ্যার শীতল পানি আর এই সবুজ জনপদ … ’
নাবিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলেন ইবনে বতুতা, ‘আমার মন জুড়িয়ে গেছে।’
নাবিল ডুব দিলো। না শীতলক্ষ্যার পানিতে নয়, ইতিহাসের পাতায়। সেই অ-নে-ক দিন আগের কথা। সোনারগাঁও বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। আর আজ নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা মাত্র। এর পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ। চারদিকে নদ-নদী দিয়ে ঘেরা যেন একটি নিরাপদ দ্বীপ। রাজধানী যেন খুব সহজে শত্রুরা আক্রমণ করতে না পারে, সেই কথা ভেবেই মুসলিম শাসকরা সোনারগাঁকে রাজধানী করেছিলেন। মুসলিম শাসকেরা নিরাপত্তা কৌশল, নদীপথে সহজ যোগাযোগ এবং রাজধানী করার জন্য স্থানগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়েই সোনারগাঁওকে রাজধানী হিসেবে পছন্দ করেছিলেন।
সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন নাম সুবর্ণগ্রাম। এই সুবর্ণগ্রাম থেকেই স্পষ্টত মুসলিম আমলের সোনারগাঁও নামের উদ্ভব। এর কাছাকাছি লাঙ্গলবন্দ ও পঞ্চমীঘাট। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এর নাম ছিল সুবর্ণবীথি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজ রায় বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তার রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এই অঞ্চল দখল করে লখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এর ফলে সোনারগাঁওয়ে হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।
মূলত বঙ্গ অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৬১০ সালে ঢাকা নগরের অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত সোনারগাঁও ছিল দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র। এ প্রশাসন স্থাপনার বিস্তৃতি ছিল অর্থনৈতিক থেকে সামরিক কর্মকান্ড পর্যন্ত।
সোনারগাঁও লখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ১৩২২ সালে গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহের ক্ষমতালাভের আগ পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ের গুরুত্ব সাময়িকভাবে হ্রাস পায়। তবে এটি একটি সমৃদ্ধ বন্দর ও টাঁকশাল শহর হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছিল। ১৩২৪ সালে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলা অধিকার করে লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁওকে আলাদা প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। ফলে সোনারগাঁও বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ সাল পর্যন্ত সোনারগাঁও ফখরউদ্দীন মোবারক শাহ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ১৩৫২ সালে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করেন এবং সেখান থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। ঈসা খান ও তাঁর বংশধরদের শাসনামলেও এই সমৃদ্ধ সোনারগাঁও তাদের রাজধানী ছিল। ১৬১১ সালে মুসা খানের পতনের পর সোনারগাঁও মুঘল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। ১৬১০ সালে ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পর থেকেই দ্রুত সোনারগাঁওয়ের গুরুত্ব কমতে থাকে। মধ্যযুগের সোনারগাঁওয়ের একটি অংশে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গড়ে উঠেছিল ঐতিহ্যবাহী পানামনগর যা আজো জরাজীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে। সোনারগাঁওয়ের সমৃদ্ধির যুগে সমগ্র মোগরাপাড়া ও গোয়ালদি এলাকায় সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত মুসলিম রাজধানী শহরটি মেনিখালী নদীর উত্তর তীরবর্তী মোগরাপাড়া ও এর চারদিকের এলাকা এবং গোয়ালদি-বৈদ্যের বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এক সময় সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুত মসলিন কাপড় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে মসলিন শিল্প ধ্বংস করতে ইংরেজেরা মসলিন বুনন কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল। ইংরেজদের এ অত্যাচারের কথা মনে পড়তেই চমকে ওঠে নাবিল।

১১.
নাবিল ভাবছে। আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বার বার পরাধীনতার শিকলে বন্দী হয়েছে। বাংলা, বিহারের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ, অর্থমন্ত্রী জগৎশেঠ, প্রধানমন্ত্রী উমি চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দুই শত বছর ইংরেজ বেনিয়াদের শাসনের নামে শোষণ চলেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয়ের পর থেকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলার অনেক দামাল সন্তান শিকল ভাঙার ডাক দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ইংরেজ শাসনের অবসানের নামে দেশ বিভাগ। ভারত পাকিস্তান নামে দুই দেশের সৃষ্টি। বাংলাদেশের পায়ে এ যেন আরেক শিকল। স্বাধীনতার নামে স্বনাম হারানোর গল্প। তারপরও ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৯ ও ১৯৭১।
: কী ভাবছো।
: তুমি তো সব বুঝতেই পরো?
: ‘বুঝতে পারি বলেই বলছি। তোমার স্বপ্ন অবশ্যই পূরণ হবে। ইতিহাসের সব মহানায়কের সাথেই তোমার দেখা হবে। এবারের সফরে না হোক পরের পর্বে অবশ্যই হবে। এখন নিচে তাকিয়ে দেখ।’ ঘোড়ার সাথে আলাপের ফাঁকে নিচে তাকিয়ে নাবিল চিৎকার করে ওঠে : এ তো মুজিবনগর। মেহেরপুরের অখ্যাত গ্রাম ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলায় আমবাগান। এখানেই তো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নিয়েছিলো। এখানে একটু নামো ফিরো চলো ১৯৭১।
: নামছি। তবে চিৎকার করবে না। সবাই ব্যস্ত মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কাউকে বিরক্ত করবে না, শুধু দেখবে।
নাবিল কোন কথা বলে না। সে হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়।
‘মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার এই আমবাগান। বর্তমানের ঐতিহাসিক মুজিব নগর। এমনই এক আমবাগানে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য ডুবে ছিল। এই পলাশীর অবস্থান এখান থেকে খুব দূরে নয়।
আজ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান চলছে। নাবিল চোখভরা বিস্ময় নিয়ে দেখছে। অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শপথ গ্রহণ করছেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ হয় মুজিবনগর। সে সরকারও পরিচিতি পায় মুজিবনগর সরকার নামে। মুজিবনগর বাংলার অস্থায়ী রাজধানীর স্বীকৃতি পায়। মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পর টনক নড়ে পাকবাহিনীর। তারা তৎকালীন কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ২১ ও ২৩ এপ্রিল এবং পরে আরও কয়েকবার পাকিস্তানি বাহিনী সেখানকার ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে প্রবাসী সরকার। এই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক।
নাবিল ভাবে জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন স্বৈরাচারী শক্তিই টিকতে পারে না। তার প্রমাণ মুজিবনগর সরকার পরিচালিত ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল এই অখ্যাত গ্রামে শপথ নেয়া সরকার। ওই সরকারের মূল ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উল্টো আক্রমণ চালায় বাংলার নিরীহ মানুষের ওপর। তা প্রতিরোধ করে স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করলেও সরকার গঠন করা হয় ১০ এপ্রিল। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ হন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। ওই সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অস্থায়ী সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধকে সর্বজনীন করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করা হয়। ওই পরিষদের ছয় সদস্যের মধ্যে জীবিত আছেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ (ন্যাপ মোজাফ্ফর)। প্রয়াত বাকি পাঁচজন ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সিপিবির সভাপতি মণি সিংহ, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মনোরঞ্জন ধর। এ ছাড়া পদাধিকারবলে ওই পরিষদে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। কার্যত তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় প্রবাসী সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে ডিসেম্বরের শুরুতে এসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় যৌথ কমান্ড। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ কমান্ডের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।’

১২.
ওপরে নীল আকাশ। নিচে লাল মাটির পাহাড় আর সবুজ বন। নাবিলের মনপবনের ঘোড়া চলছে ভাওয়ালগড়ের ওপর দিয়ে। নিচে সারি সারি গজারির বন দেখে ওর মনে ইচ্ছে জাগে সবুজ এই বনটা একটু ঘুরে দেখার। যদিও বন থেকে খুব দূরে নয় নাবিলদের বাসা। তারপরও গাজীর শহর ছেড়ে এই লালমাটির পথে কোন দিন আসা হয়নি ওর। নাবিলের মনের খবর জানতে পেরে ওর টাইমমেশিন ঘোড়া আস্তে আস্তে নিচে নেসে এলো। নিচে নামতেই নাবিল অবাক! তার সামনে এই সুদর্শন ঘোড়সওয়ার কে?
নাবিলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা বুঝতে পেরে ঘোড়সওয়ার যুবক সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে : ‘আমার নাম বাহাদুর গাজী। এই যে তোমাদের গাজী এটা ছিলো আমাদেরই জমিদারির অংশ।’
নাবিলের সালামের উত্তর দিয়ে বলে : ‘এই ভাওয়ালগড়ের জমিদার তো ছিলেন ভাওয়ালরাজ রাজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ।’
: সে আমাদের অনেক পরে।
: তার মানে।
: ‘বলছি তা হলে শোন, ১৬০২ সালে আমার বাবা ফজল গাজী ছিলেন ভাওয়াল রাজ্যের শাসক। তার মৃত্যুর পর আমি ছেলে বাহাদুর গাজী পরগনার শাসক নিযুক্ত হই। তারপর আমার পুত্র কাসেম গাজী শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। ১৬৯৩ সালে কাসেম গাজীর মৃত্যুর পর তার ছেলে বরকত গাজী ভাওয়ালের শাসক নিযুক্ত হন। বরকত গাজীর ইন্তেকালের পর তার ছেলে দৌলত গাজী শাসন ক্ষমতায় আসেন। পবিত্র হজ থেকে ফেরার পথে দৌলত গাজীর ইন্তেকালে তার অনুপস্থিতিতে বলরাম রায় নিলাম ডাকে অংশ নিয়ে গাছার বীরেন্দ্র রায় এবং পলাশুনার নিশিকা ঘোষের সঙ্গে মিলে ১৭৩৮ সালে ভাওয়ালের জমিদারি কিনে নেন। এভাবে ১৭৩৮ সালে গাজীদের ভাওয়াল জমিদারির অবসান ঘটে এবং ভাওয়াল শাসনমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে রায় বংশের শাসকদের। ১৭৪৩ সালে বলরামের মৃত্যুর পর তার ছেলে শ্রীকৃষ্ণ রায় জমিদারির কর্তৃত্ব লাভ করেন। তার মৃত্যুর পর জয়দেব নারায়ণ জমিদারির কর্তৃত্ব লাভ করে নিজের নামানুসারে এলাকার নাম রাখেন ‘জয়দেবপুর’। জয়দেব নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইন্দ্রনারায়ণ জমিদারি লাভ করেন। তিনি বিজয় নারায়ণ, চন্দ্র নারায়ণ ও কীর্তি নারায়ণ নামের তিন ছেলে রেখে মারা যান। এদের মধ্যে কীর্তি নারায়ণের ওপর জমিদারির ভার অর্পিত হয়। কীর্তি নারায়ণ মারা যান হরিনারায়ণ, নরনারায়ণ এবং লোক নারায়ণ নামের তিন ছেলে রেখে। এদের মধ্যে কনিষ্ঠ লোকনারায়ণ জমিদারির কর্তৃত্ব লাভ করেন। লোকনারায়ণের মৃত্যুর পর তার একমাত্র ছেলে গোলক নারায়ণ ভাওয়ালের জমিদারি লাভ করেন। তার আমলেই রাজদীঘি, মাধববিগ্রহ মন্দির এবং রাজবাড়ীর ইমারত নির্মিত হয়। বাংলা ১২৬৩ সনের ১৩ পৌষ তিনি মারা যান। এরপর ভাওয়ালের শাসক হন কালীনারায়ণ রায় চৌধুরী, যিনি এ বংশের সবচেয়ে খ্যাতিমান শাসক বলে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনিই প্রথম ‘রাজা’ উপাধিপ্রাপ্ত হন। ১২৮২ বঙ্গাব্দে তিনি মারা গেলে তার একমাত্র পুত্র রাজনারায়ণ জমিদারির দায়িত্বভার নেন। ১৮০১ সালে রাজনারায়ণ ইহলোক ত্যাগ করেন, তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে। বড় ও ছোট রাজকুমার মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে উভয়ে নিঃসন্তান অবস্থায় ২৮ বছর বয়সে মারা যান। এদের মধ্যে মেজো রাজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ হচ্ছেন ভাওয়ালরাজ সন্ন্যাসীখ্যাত সেই ব্যক্তি যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল রহস্যময় কিংবদন্তি।’
: তার সেই কাহিনী তো সবার মুখে মুখে।
: তুমি জান সেই কাহিনী?
: অল্প অল্প জানি।
: তা হলে বলছি শোন, ১৯০৯ সালে বায়ু পরিবর্তনের জন্য তিনি স্ত্রী বিভাবতীসহ দার্জিলিংয়ে যান রাজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ। সেখানে স্ত্রী তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন। তিনি বিষের প্রভাবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যান। তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে তার শবদেহ শ্মশানে পোড়াতে গেলে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত। ফলে শবদেহ শ্মশানে রেখে শবদাহকারীরা আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী ঘরে। বৃষ্টির পানির প্রভাবে তিনি বিষমুক্ত হয়ে শ্মশান ত্যাগ করেন। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ ১২ বছর। এই দীর্ঘ সময় পর একদিন এক জটাধারী সন্ন্যাসী এসে জয়দেবপুরে নিজেকে মেজোকুমার বলে দাবি করেন। শুরু হয় রহস্যের খেলা, সৃষ্টি হয় অপার বিস্ময়ের কাহিনী। মেজোকুমার শোনান আশ্চর্য এক কাহিনী। শ্মশানে নিয়ে চিতায় তুলে আগুনও দেয়া হয়েছিল কিন্তু সে সময় এলো প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শবদাহকারীরা শব ফেলে চলে গেলে বৃষ্টির পানিতে চিতার আগুন নিভে যায়, তিনি তখন জ্ঞান ফিরে পান। তার গোঙানির শব্দ শুনে একদল নাগা সন্ন্যাসী তাকে নিয়ে যায় তাদের সঙ্গে। সন্ন্যাসী বেশে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর ঘুরে বেড়ান কাশী-বৃন্দাবন-বানারসি। তারপর ১২ বছর পর ফিরে আসেন জয়দেবপুরে। কিন্তু বিভাবতী তাকে স্বামী হিসেবে অস্বীকার করেন। পরে মেজোকুমার বাধ্য হয়ে ঢাকার কোর্টে মামলা করেন। চাঞ্চল্যকর ও কৌতূহলোদ্দীপক এ মামলটি ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা বলে তখন সমগ্র ভারতবর্ষে খ্যাতি লাভ করেছিল। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু মামলাটি কলকাতার হাইকোর্ট থেকে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায়। দীর্ঘ ১৬ বছর মামলা চলার পর ১৯৪৬ সালে মামলার রায় বের হয় এবং রায়ে মেজোকুমারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। রায় বের হওয়ার মাত্র তিন দিনের মাথায় মেজোকুমার মারা যান। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বলা যায় বিলুপ্ত ঘটে ভাওয়াল রাজবংশের।’
: নাবিল গাজী শব্দের অর্থ জানো?
: না গাজী শব্দের অর্থ কী?
: ন্যায়ের পক্ষ যারা যুদ্ধ করে বিজয়ী হন তাদেরকেই গাজী বলা হয়।
: আর যারা নিহত হন তাদের বলা হয় শহীদ।
: হ্যাঁ ঠিক তাই। তবে শহীদদেরকে আল্লাহতায়ালা মৃত বলতে নিষেধ করেছেন। কারণ তারা সত্য ও ন্যায়ের সাক্ষী হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকেন। গাজীপুর সত্যি সত্যি যে গাজীদের ঘাঁটি তার প্রমাণ তারা ১৯৭১ সালেও দিয়েছে।
: কিভাবে?
: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু প্রাক্কালে ১৯ মার্চ গাজীপুরেই সংঘটিত হয়েছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির পক্ষ থেকে সেদিনই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়।
নাবিল গর্বে বুক ফুলিয়ে বলে : ভাবতে খুব ভালো লাগছে। আমি গাজীপুরের বীর সন্তান।
বাহাদুর গাজী বলেন : ঠিক আছে। তোমার মা নাস্তা নিয়ে বসে আছেন, আমি আসি। তুমি এবার বাড়ি যাও।
বাড়ি পৌঁছার পর নাবিলের টাইমমেশিন ঘোড়া বিদায় নিয়ে বলে : বন্ধু এবার আরামে ঘুমাও। আমি আসি। আবার দেখা হবে।
: ‘নাবিল নাবিল। স্কুলের সময় হয়ে গেছে এবার উঠো।’ মায়ের স্নেহভরা হাতের ছোঁয়ায় নাবিলের ঘুম ভাঙে। পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি : আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।

SHARE

Leave a Reply