Home দেশ পরিচিতি পর্বতময় দেশ তাজিকিস্তান -মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

পর্বতময় দেশ তাজিকিস্তান -মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

তাজিকিস্তান দক্ষিণ-পূর্ব মধ্য এশিয়ার একটি পার্বত্য ও স্থলবেষ্টিত দেশ। দেশটির ৯০ শতাংশেরও বেশি জুড়ে রয়েছে পর্বত। এদেশের মোট ভূমির ৫০ শতাংশেরও বেশির উচ্চতা সমুদ্রস্তর থেকে ৩ হাজার মিটার বা ৯ হাজার ৮০০ ফুট। তাজিকিস্তান আয়তনের দিক দিয়ে মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশ। আয়তন ১ লাখ ৪৩ হাজার ১শ’ বর্গ কিলোমিটার (৫৫ হাজার ৩শ’ বর্গ মাইল) এবং জনসংখ্যা ৮৭ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫১ জন। এদেশের উত্তরে কিরগিজিস্তান, উত্তরে ও পশ্চিমে উজবেকিস্তান, পূর্বে গণচীন এবং দক্ষিণে আফগানিস্তান। দুশানবে দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। তাজিকিস্তানের গোর্নো-বাদাখশান স্বায়ত্তশাসিত এলাকাটি একটি জাতিগত অঞ্চল এবং এটি দেশটির ৪৫% এলাকা জুড়ে অবস্থিত।
তাজিকিস্তানের জনগণের অধিকাংশই তাজিক জাতির লোক। জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে তাজিক ৮৪.৩ শতাংশ, উজবেক ১৩.৮ শতাংশ, কিরগিজ ০.৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ১.১ শতাংশ। তাজিকিস্তান সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও জনগণের শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলিম, ১.৬ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ০.৪ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এককালে তাজিক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী আবাসভূমির অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তান। এদেশের জনগণ তাজিক নামের একটি ফার্সি জাতীয় ভাষায় কথা বলে।
১৯২৯ সালে তাজিকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার ঠিক পর পরই দেশটিতে সাম্যবাদী সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে দুই পক্ষ একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
তাজিকিস্তানের শাব্দিক অর্থ তাজিকদের আবাসস্থল। বিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েকটি দশকে সোভিয়েত প্রশাসনের অধীনে চলে যাওয়ার পরই এ নামটি তাজিকদের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর আগে কখনো ইরানের কোনো অংশের জন্য অথবা ইরানি ভাষাভাষী লোকদের জন্য এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। সোভিয়েত প্রশাসনই মধ্য এশিয়ার তাজিক জনগণের জন্য এ শব্দটি নির্বাচন করে।
তাজিকিস্তানের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রপতি হলেন একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান ও সরকারপ্রধান। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার এবং ৬৩ সদস্যের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ওপর ন্যস্ত। ২০০৩ সালের নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ৭ বছর মেয়াদের জন্য জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রীর পদের তেমন কোন ক্ষমতা নেই। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ সরকার থেকে স্বাধীন। তাজিকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রহমন এবং প্রধানমন্ত্রী কোখির রাসুলজোদা। তাজিকিস্তানের প্রশাসনিক এলাকা চারটি প্রদেশে (ভিলোইয়াত) বিভক্ত। সেগুলো হলো সুঘদ (রাজধানী খুজান্দ), রিপাবলিকান সাবঅর্ডিনেশন রেজিওন (রাজধানী দুশানবে), খাটলন (রাজধানী কুরঘনতেপ্পা) ও গোর্নো বাদাখশান (রাজধানী খোরাঘ)।
তাজিকিস্তানের পামির পর্বতমালা এবং আলায় পর্বতমালা দু’টি প্রধান পর্বতমালা এবং এগুলির হিমবাহ থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন পার্বত্য জলধারা ও নদী প্রাচীনকাল থেকে ঐ অঞ্চলের খামারভূমিতে সেচকাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাজিকিস্তানের উত্তর প্রান্তে মধ্য এশিয়ার আরেক প্রধান পর্বতমালা তিয়ান শান পর্বতমালার একাংশ চলে গেছে। পর্বতগুলোর উত্তরে ও দক্ষিণে রয়েছে দুইটি নিম্নভূমি অঞ্চল এবং এখানেই তাজিকিরা ব্যাপক পরিমাণে বাস করে।
মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকা সির দরিয়া নদীবিধৌত ফের্গানা উপত্যকার একাংশ উত্তর তাজিকিস্তানে পড়েছে। এই দীর্ঘ উপত্যকাটি উত্তরে কুরামিন পর্বতমালা ও দক্ষিণে তুর্কেস্তান পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত। দক্ষিণের নিম্নভূমি এলাকাটিতে আমু দরিয়া ও পাঞ্জ দু’টি প্রধান নদী। তাজিকিস্তানের ২ শতাংশ ভূমি জুড়ে আছে হ্রদ। সুপরিচিত কয়েকটি হ্রদ হলো কায়রাকুম, ইসকানদেরকুল, কুলিকালন, কারাকুল, সারেজ, শাদউ লেক ও জরকুল।
মধ্য এশিয়ার দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তাজিকিস্তান অন্যতম। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থানও তেমন একটা সুবিধাজনক স্থানে নেই। ২০০১ সালে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে চলে যায় যে, সে বছরের ২১ আগস্ট রেড ক্রস তাজিকিস্তানকে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত দেশ বলে ঘোষণা করে এবং দেশটির জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থনা করে। পরবর্তী বছরগুলোতে তাজিকিস্তান কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং পার্শ্ববর্তী তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছে যায়। তাজিকিস্তানের মুদ্রার নাম সোমোনি।
তাজিকিস্তানের অর্থ খাতের প্রধান ভূমিকা পালনকারী বিষয়গুলো হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম ও তুলা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। রাষ্ট্র পরিচালিত অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি ট্যালকো মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি। এ ছাড়া দেশটি হাইড্রোইলেকট্রিক শক্তি উৎপাদনে বিশ্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এ খাতে দেশটিতে রাশিয়া, চীন ও ইরান অর্থ বিনিয়োগ করছে।
তাজিক ও রুশ ভাষা তাজিকিস্তানের সরকারি ভাষা। তাজিকিস্তানে প্রচলিত অন্যান্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে উজবেক ভাষা, ফার্সি ভাষা এবং পশতু ভাষা।
তাজিকিস্তানে ২০০৯ সালে ইসলামকে সরকারি ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে তাজিকিস্তানে অন্য ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। দেশটির জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ সুন্নি এবং ৩ শতাংশ শিয়া। আর বাকি দুই শতাংশের মধ্যে অর্থোডক্স, প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও ইহুদি রয়েছে। তাজিকিস্তানের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে নিবন্ধন করতে হয়। এই নিবন্ধন ছাড়া কোনো দল উপাসনার জন্য একত্রিত হতে পারবে না। এর ব্যতিক্রম করলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি তাদের উপাসনাস্থল বন্ধ করে দেয়া হয়।
দেশটি ২০০২ সাল থেকে তার জিডিপির ৩.৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে খরচ করে আসছে। দেশটির ৯৯.৫ শতাংশ লোক লিখতে ও পড়তে পারে।
ঐতিহাসিকভাবেই তাজিক এবং পার্সিয়ানরা একই ভাবধারার। তাদের ভাষাও কাছাকাছি পর্যায়ের। বর্তমানে দেশটির রাজধানী দুশানবে, খুজান্দ, দুলব, পাঞ্জাকেন্ট এবং ইস্তারভশান প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। উত্তর তাজিকিস্তানে ২৫ হাজার লোক রয়েছে ইয়াগনোবি সম্প্রদায়ের। তারা ইয়াগনোবি ভাষাতেই কথা বলে থাকে।
পর্বতময় তাজিকিস্তানের খেলাধুলাও পাহাড়পর্বতকেন্দ্রিক। পাহাড়ে হাঁটা, উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করা ইত্যাদিই এখানকার প্রধান খেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতি মৌসুমে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্বত এজেন্সিগুলো বিভিন্ন খেলার আয়োজন করে থাকে। এর পাশাপাশি দেশটিতে ফুটবলও একটি জনপ্রিয় খেলা। তারা ফিফা ও এএফসি আয়োজিত বিভিন্ন খেলায় অংশ নিয়ে থাকে।
তাজিকিস্তান নামে যে স্থানটি বর্তমানে পরিচিত তার পত্তন হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে। তখন থেকে এ ভূখন্ডটি বিভিন্ন সম্রাটের শাসনাধীনে ছিল। বিশেষ করে পারস্যের সম্রাটদের অধীনে এ ভূখন্ডটি থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। বুদ্ধ-পূর্ব যুগে আধুনিক তাজিকিস্তান জারাভশান ভ্যালির অন্তর্ভুক্ত হয়ে কামবোজার অংশ ছিল। আর তখন কামবোজা সাম্রাজ্যটি শাসন করত পারস্যের আচেহমানিদ সম্রাটরা। আলেকজান্ডারের হাতে পারস্য সম্রাটদের পরাজিত হওয়ার পর এ অঞ্চলটি গ্রেসো-ব্যাকট্রিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ হিসেবে পরিগণিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত এটি ব্যাকট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবেই থাকে। এরপর এটা হয়ে যায় তুর্কিস্তানের অংশ। তারপর কিছু দিন এটি চীন সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে গণ্য হয়।
সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে আরবরা এ অঞ্চলে ইসলাম নিয়ে আসেন। সম্রাট সামানিড তখন আরবদের উচ্ছেদ করেন। সে সময় তিনি সমরখন্দ ও বোখারাকে আরো বড় ও সমৃদ্ধ করে তোলেন। এরপর থেকে উভয় শহর তাজিকদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য হতে থাকে (উভয় শহরই এখন উজবেকিস্তানের অন্তর্গত)। এরপর মোঙ্গোলরাও কিছু সময়ের জন্য এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এমনিভাবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে কখনো এই অংশের সাথে কখনো ওই অংশের সাথে যুক্ত হয়ে এগিয়ে গেছে তাজিকিস্তানের ইতিহাস।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার সম্রাটরা মধ্য এশিয়ায় তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৮৬৪ এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে রাশিয়া উত্তরে বর্তমান কাজাখস্তান, পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আফগানিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ১৯১৭ সালে এ অঞ্চলে যখন রাশিয়ার ক্ষমতা কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়, তখন এ অঞ্চলের তুর্কিস্তানের অংশের ক্ষমতা দখল করে নেয় বলশেভিকরা। এ ক্ষোভ থেকেই বাসমাচি গোষ্ঠী গেরিলা কার্যক্রম শুরু করে। পরে তারা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সোভিয়েত শাসনাধীন খিবা ও বোখারা জয় করে নেয়। কিন্তু এরপর বিভিন্ন কারণে তাদের এই স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। চার বছরব্যাপী এ যুদ্ধের পর বলশেভিক সৈন্যরা তাজিকিস্তানের গ্রাম ও মসজিদগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং লোকজনকে ব্যাপক হারে গ্রেফতার করে। এর পর থেকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রচারণা শুরু করে। এ সময় তারা ধর্মপ্রাণ মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের নির্যাতন করতে থাকে। একই সময় মসজিদ, চার্চ ও সিনাগগগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
১৯২২ সালেই বাসমাচি আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেলেও সোভিয়েত সরকার প্রতিবিপ্লব দমন করার জন্য মধ্য এশিয়াকে জাতিভিত্তিক পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান নামে দু’টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র গঠন করে। এ সময় তাজিক ও কিরগিজ নামে দুইটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র গঠিত হলেও এগুলো ছিল উজবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশ। ১৯২৯ সালে তাজিকিস্তানকে পূর্ণাঙ্গ ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা হয়। এ সময়ে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা এবং শিল্প সব দিক দিয়েই তাজিকিস্তান সোভিয়েতের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর পেছনে পড়ে যায়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ অবস্থাই চলতে থাকে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাজিকিস্তান থেকে তার নিয়ন্ত্রণ গুটিয়ে নেয় এবং তাজিকিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
স্বাধীনতা পাওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যেই গোত্রগত দলাদলির কারণে তাজিকিস্তানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় অমুসলিম নাগরিক বিশেষ করে ইহুদি এবং রুশরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। নির্যাতন ও দারিদ্র্যের আশঙ্কা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আশায় তারা পাশের অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত দেশে পালিয়ে যায়।

SHARE

Leave a Reply