বেজে উঠেছে ফুটবল মহাযুদ্ধের দামামা। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আয়োজন বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের আসরটি বসবে রাশিয়ায়। চূড়ান্ত হয়েছে ৩২টি দল, কে কোন গ্রুপে খেলবে তাও ঠিক হয়ে গেছে। এবার অপেক্ষা চূড়ান্ত লড়াইয়ের। বিশ্বকাপ ফুটবলের ২১তম আসর এটি। আগামী ১৪ জুন উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক রাশিয়ার মোকাবেলা করবে সৌদি আরব। গত ১ ডিসেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর স্টেট ক্রেমলিন প্যালেসে অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রুপনির্ধারণী ড্র। ৩২টি দলকে ভাগ করা হয়েছে ৮টি গ্রুপে। রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে পরস্পরের বিপক্ষে খেলে সেরা দুই দল যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে লড়াই হবে নকআউট পদ্ধতিতে।
গ্রুপ অব ডেথ
বিশ্বকাপের ড্রয়ের পর যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হয় তা হলো গ্রুপ অব ডেথ, বাংলায় বলা যায় মৃত্যুকূপ। অর্থাৎ প্রথম সারির দুই বা তিনটি দল একই গ্রুপে পড়লে তাকে বলা হয় গ্রুপ অব ডেথ। এই গ্রুপ থেকে যে কোন বড় দলকে বিদায় নিতে হয় প্রথম রাউন্ড থেকে। ১৯৯৮ সালে যেমন আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, সুইডেন ও নাইজেরিয়া একই গ্রুপে পড়ে। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় বাতিস্তুতার আর্জেন্টিনা। ২০১৪ বিশ্বকাপে তেমনি ইতালি, ইংল্যান্ড ও উরুগুয়ে ছিলো একই গ্রুপে। বিদায় নিতে হয়েছে ইতালি ও ইংল্যান্ডকে। আর্জেন্টিনা এবারো পড়েছে কঠিন গ্রুপে। ডি গ্রুপে তাদের সাথে আছে ১৯৯৮ আসরে তৃতীয় হওয়া ক্রোয়েশিয়া ও আফ্রিকার সুপার ঈগল খ্যাত নাইজেরিয়া। এরা যে কেউ ম্যাচ জেতার সামর্থ্য রাখে। আইসল্যান্ড বিশ্বকাপে নতুন হলেও তারা ইতালি, নেদারল্যান্ডসের মতো দলকে পেছনে ফেলে বিশ্বকাপে এসেছে। তাই খুব সাবধানেই বাছাই পর্ব খেলতে হবে মেসি বাহিনীকে। বি গ্রুপে আছে পর্তুগাল ও স্পেন। এই গ্রুপের অন্য দু’টি দল মরক্কো ও ইরান তুলনামূলক দুর্বল হলেও বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কারো জন্য। বড় দলগুলোর মধ্যে ব্রাজিল ও জার্মানি পড়েছে তুলনামূলক সহজ গ্রুপে। ড্রয়ের সময় সেরা আটটি দলকে আগেই আট গ্রুপে রাখা হয় যাতে কয়েকটি বড় দল একই গ্রুপে না পড়ে। তবুও আটটির বাইরে যে শক্তিশালী দল রয়েছে তারা কঠিন করে তোলে গ্রুপ। আবার একই মহাদেশের দলগুলোকেও পৃথক গ্রুপে রাখা হয় (ইউরোপ ছাড়া)।
যেমন ছিলো বাছাই পর্ব
নিয়মানুযায়ী স্বাগতিক রাশিয়া বাছাইপর্ব ছাড়াই সরাসরি খেলবে বিশ্বকাপে। বাকি ৩১টি কোটার জন্য লড়াই করেছে ২১০টি দেশ। আবেগ-উচ্ছ্বাস, হাসি-কান্না ছিলো পুরো বাছাই প্রক্রিয়া জুড়ে। মধ্য আমেরিকার ছোট্ট দেশ পানামা ও ইউরোপের বিচ্ছিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ড সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আবার বড় দল হিসেবে পরিচিত কেউ কেউ কেঁদে বিদায় নিয়েছে মাঠ থেকে। ২০০২ সালে প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে এসে চমক দেখানো সেনেগাল আবার সুযোগ পেয়েছে ১৬ বছর পর। দীর্ঘ ২৮ বছর পর খেলবে মিসর, মরক্কো ২০ বছর ও সৌদি আরব খেলবে ১২ বছর পর। রীতি অনুযায়ী ইউরোপ মহাদেশ থেকে ১৪টি (রাশিয়াসহ), এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে ৫টি করে, কনকাকাফ অঞ্চল (উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয়) থেকে ৩টি দল সুযোগ পেয়েছে।
মেসি ম্যাজিকে রক্ষা আর্জেন্টিনার
রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সব আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো আর্জেন্টিনা। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বাছাই পর্বে শুরু থেকেই বেকায়দায় ছিলো লিওনেল মেসির দল। আর্জেন্টিনাকে ছাড়াই বিশ্বকাপ দেখতে হবে কি না এমন আলোচনা ছিলো সর্বত্র। এমন সমীকরণ নিয়ে শেষ ম্যাচ খেলতে নামেন ম্যারাডোনা-বাতিস্তুতার উত্তরসূরিরা। ম্যাচটি ছিলো ইকুয়েডরের মাঠে তাদের বিপক্ষে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার মিটার উঁচুতে বিদেশী দলগুলোর পক্ষে খেলা এমনিতেই কঠিন। তার ওপর ম্যাচে মাত্র ৪০ সেকেন্ডের মাথায় গোল করে এগিয়ে যায় ইকুয়েডর। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের চোখে তখন হতাশার অন্ধকার। কিন্তু ঠিক এমনই ‘বাঁচা-মরার’ মুহূর্তে জ্বলে উঠলেন লিওনেল মেসি। পাহাড় সমান চাপ নিয়ে মাঠে নেমে ছিলেন, সেই চাপ যেন তাকে আরো বেশি দায়িত্বশীল করেছে। এমন ম্যাচে তাই কারো ওপর ভরসা না করে একাই করলেন সবটুকু। দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে হারালেন ইকুয়েডরকে। ম্যাচে ৩-১ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। পুরো ম্যাচেই মেসি দু’পায়ে নাচিয়ে ছেড়েছেন ইকুয়েডরের ডিফেন্ডারদের। যারা এত দিন ‘জাতীয় দলে মেসি ভালো খেলেন না’ বলে সমালোচনা করতেন তাদের মুখ বন্ধ করে দিলেন মেসি।
ইতালি ট্র্যাডেজি
রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের সবচেয়ে বড় নাটকীয়তার নাম যদি হয় আর্জেন্টিনা, তাহলে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নিঃসন্দেহে ইতালি। চারবারের চ্যাম্পিয়নরা বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ ৬০ বছর পর ইতালিকে ছাড়া বিশ্বকাপ হবে। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১৯ বিশ্বকাপ আসরে মাত্র একবারই বাছাই পর্ব পার হতে ব্যর্থ হয়েছে ইতালি, ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে। আর ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপে দূরত্বের কারণে ইচ্ছে করেই অংশ নেয়নি আজ্জুরিরা।
আর্জেন্টিনার মতোই সুতোয় ঝুলে ছিলো ইতালির ভাগ্য। কিন্তু পার্থক্য হলো মেসির মতো কেউ একক জাদুতে পার করতে পারেননি ইউরোপের দেশটিকে। চারবারের চ্যাম্পিয়ন (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২ ও ২০০৬), দুইবার রানার্সআপ, একবার তৃতীয় ও একবার চতুর্থ হওয়া ইতালি এবার থাকছে না বিশ্বকাপে। অবশ্য ২০০৬ সালে শিরোপা জেতার পর থেকেই শুরু হয়েছিলে দলটির পতন। গত দু’টি বিশ্বকাপেও তারা বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ড থেকে। হতাশায় আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির সবচেয়ে বড় তারকা জিয়ানলুইজি বুফন। ২০১১ সাল থেকে দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ৫টি বিশ্বকাপে খেলা গোলরক্ষক বুফন ছিলেন ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলেও।
আরো যারা থাকছে না
ফুটবল বিশ্বে বড় দল হিসেবে পরিচিত নেদারল্যান্ডসও রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। তাই তো রাশিয়ার মাঠে দেখা যাবে না আরিয়েন রোবেনের সেই ক্ষিপ্রতা। ২০১০ বিশ্বকাপের এই ফাইনালিস্টরা এমনকি প্লে-অফে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি। দেখা যাবে না অ্যালেক্সিস সানচেজ, এরিক ভিদাল কিংবা গ্যারেথ বেলের মত মাঠ কাঁপানো তারকাদের। চিলি পরপর দুটো কোপা আমেরিকা কাপ জিতলেও এবারের বিশ্বকাপে থাকছে না। বাছাই পর্বের বাধা পার হতে পারেনি তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র।