শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। ভারতের সাথে উত্তর-পশ্চিমে এবং মালদ্বীপের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমা রয়েছে। সিংহলি ভাষায় শ্রীলঙ্কাকে বলা হয় শ্রী লাংকাবা এবং তামিল ভাষায় ইলাংকাই। দেশটির সরকারি নাম গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা। ১৯৭২ সালের আগে এই দ্বীপটি সিলন নামে পরিচিত ছিল। এর প্রশাসনিক রাজধানীর নাম শ্রী জয়াবর্ধনপুর কোট। এর প্রধান শহর কলম্বো। ভারতের দক্ষিণ উপকূল হতে ৩১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা।
মার্কো পোলো পানির পড়ন্ত ফোঁটা আকৃতির শ্রীলংকাকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দর দ্বীপ হিসেবে নির্দেশ করেছিলেন। আসলেই শ্রীলঙ্কা নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
শ্রীলঙ্কার আয়তন ৬৫ হাজার ৬১০ বর্গ কিলোমিটার (২৫ হাজার ৩৩০ বর্গ মাইল)। জনসংখ্যা ২ কোটি ২২ লাখ ৩৫ হাজার। জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে সিংহলি শতকরা ৭৫ ভাগ, শ্রীলংকান তামিল ১১ ভাগ, মুর ৯.২ ভাগ, ভারতীয় তামিল ৪.২ ভাগ এবং অন্যান্য ০.৫ ভাগ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বার্ঘার, কাফির, মালয় উল্লেখযোগ্য। প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ ৭০.২ শতাংশ, হিন্দু ১২.৬ শতাংশ, মুসলিম ৯.৭ শতাংশ, খ্রিষ্টান ৭.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.১ শতাংশ। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মাবম্বলীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।
সিংহলিজ এবং তামিল শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ভাষা। শতকরা ১০ ভাগ লোক ইংরেজিতে সার্বক্ষণিক কথা বলে এবং শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবসায়িক কাজে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অনেক বেশি। বার্ঘার সম্প্রদায়ের লোকজন পর্তুগিজ ও ডাচ ভাষা ভিন্ন উচ্চারণে বলে থাকে। অন্যদিকে মালয় সম্প্রদায়ের লোকজন মালয়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে থাকে।
শ্রীলঙ্কা চা, কফি, নারিকেল, রাবার উৎপাদন ও রফতানিতে বিখ্যাত। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংবলিত সমুদ্রসৈকত, ভূদৃশ্য তদুপরি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা অনেক নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিক ভূগোলবিদগণ একে তপ্রোবান এবং আরবরা সেরেনদীব নামে ডাকত। ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা এই দ্বীপে পৌঁছে এর নাম দেয় শেইলাও যার ইংরেজি শব্দ হলো সিলন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনে থাকা অবস্থায় শ্রীলঙ্কা সিলন নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৪৮ সালে এই নামেই স্বাধীনতা পায় এবং পরে ১৯৭২ সালে দাপ্তরিক নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, মুক্ত, সার্বভৌম ও স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শ্রী’ ও ‘লংকা’ থেকে। শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লংকা অর্থ দ্বীপ।
প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সৈকত ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বণিকদের কাছে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ এখানে ব্যবসা করত। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা সর্বপ্রথম এখানে পৌঁছায়। ১৭শ শতাব্দীর দিকে ডাচরা আসে যদিও ১৭৯৬ সালে দ্বীপটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। ১৮১৫ সালে ক্যান্ডি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এলে সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশ এখানে চা, রাবার, চিনি, কফি এবং নীলের চাষ শুরু করে। তখন কলম্বোকে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তারা আধুনিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, রাস্তাঘাট এবং চার্চ তথা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের নির্যাতন-অত্যাচারের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সিলন নামে দেশটি স্বাধীনতা পায়। ১৯৬০ সালের ২১ জুলাই শ্রীমাভো বন্দেরনায়েক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন সারা পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালে শ্রীমাভো বন্দেরনায়েকের প্রধানমন্ত্রিত্বে সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা নামকরণ করা হয়।
শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরের বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী রামের শাসন আমলে ভারতের মূল ভূমি থেকে একটি স্থল সংযোগ ছিল। ব্রিটিশ উপনেবিশের বর্ণনাকারীদের মতে ১৪৮০ সালের ঝড়ে ধ্বংস হবার আগে এটা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছিল। কেবল দক্ষিণ দিকের বেড়ে ওঠা পর্বতমালা ছাড়া দ্বীপটির বেশির ভাগ উপকূলীয় সমতল ভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫২৪ মিটার (৮২৮০ ফুট) উঁচু পিদুরুতালাগালা শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ স্থান।
শ্রীলঙ্কায় সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার সমন্বয়ে। রাষ্ট্রপতি শ্রীলঙ্কার একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক বাহিনীর প্রধান, প্রশাসক ও সরকারপ্রধান এবং তিনি নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য। রাষ্ট্রপতি দেশের সংসদ এবং ২২৫ সদস্যের আইন প্রণয়নকারী পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির ডেপুটি হিসেবে কাজ করেন এবং সংসদের সরকারি দলের নেতৃত্ব দেন। শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপাল সিরিসেন ও প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি নির্বাচিত হন।
শ্রীলঙ্কা জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, সার্ক, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিল, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এবং কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য দেশ।
উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সর্বোচ্চ সাক্ষর জনসংখ্যার একটি দেশ, যার সাক্ষরতার হার ৯২ শতাংশ। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে গ্রেড ১ থেকে ১৩ পর্যন্ত পাঠদান ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পরীক্ষা যথাক্রমে ১১ এবং ১৩ গ্রেডে অনুষ্ঠিত হয়। বেশির ভাগ বিদ্যালয় ব্রিটিশ বিদ্যালয়ের ধাঁচে গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কলোম্ব বিশ্ববিদ্যালয়, পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জয়াবর্ধনপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, জাফনা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় খেলা ভলিবল হলেও ক্রিকেট এদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়। ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯৬ ও ২০০৪ সালে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন এবং ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের রানার্সআপ।
শ্রীলঙ্কার দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থান হচ্ছে কলম্বো, অনুরাধাপুর, ক্যান্ডি, পোলোন্নারুভা, আদম পর্বত, শ্রীলঙ্কার জাতীয় জাদুঘর প্রভৃতি।
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো একই সাথে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা ধারণ করে আছে। শ্রীলঙ্কার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান বুদ্ধমন্দির কেলানিয়া রাজা মহাভিহার যা কলম্বোতে অবস্থিত। প্রত্যেক জানুয়ারি মাসে এ মন্দিরে ধার্মিক অনুষ্ঠান পেরাহেরা অনুষ্ঠিত হয়। কলম্বোকে “বুদ্ধের শহর” বলা যেতে পারে। কেননা এখানে কয়েক কদম পরপর এবং সর্বত্র ‘বুদ্ধের’ মূর্তি দেখা যায়।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি কলম্বোতে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর মসজিদ আছে।
এখানে দেখার মতো রয়েছে গল ফেস গ্রিন সৈকত। সুনীল সমুদ্র, নয়নাভিরাম সৈকতের পাশাপাশি এই সৈকতে রয়েছে উত্তাল ঢেউয়ের সাথে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা। এই এলাকায় পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ আমলের দুর্গ রয়েছে যা পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া রয়েছে কলম্বো থেকে ১২ কিমি দূরে অবস্থিত মাউন্ট লাভিনিয়া সৈকত। ১৮০৫ সালে তৈরি গভর্নর হাউজ এখানে অবস্থিত, যা এখন মাউন্ট লাভিনিয়া হোটেলে পরিণত হয়েছে। কলম্বোতে দেখার মতো আরও রয়েছে এলিফ্যান্ট শো এর জন্য বিখ্যাত চিড়িয়াখানার নাম দেহিওয়ালা জু।
আরেকটি দর্শনীয় স্থান প্রাচীন শহর অনুরাধাপুর কলম্বো থেকে ২০৬ কিমি দূরে অবস্থিত। অনুরাধাপুরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। এখানে আছে ১৩ মিটার উঁচু গ্রানাইট পাথরের তৈরি গৌতম বুদ্ধের মূর্তি যা আওকনা বুদ্ধ নামে পরিচিত। রাজা দাথুসেনের শাসনকালে নির্মিত হয়েছে এটি। এছাড়াও রয়েছে রক কার্ভিংসের জন্য বিখ্যাত মন্দির ইসরুমিনিয়া মন্দির যা তৃতীয় শতাব্দীতে নির্মিত হয়। এ ছাড়াও এখানে দেখার মতো আছে মিহিনতালের মন্দির, জেথাওয়ানের মঠ, ওয়ানভেনির সেয়া এবং আশ্রমগুলো।
ক্যান্ডিতে রয়েছে দ্য টেম্পল অব টুথ, দ্য ওল্ড ওয়েল প্যালেস কম্পাউন্ড, লঙ্কাতিলকা মন্দির, এম্বেকা মন্দির যা অবশ্যই দেখার মতো জায়গা। ক্যান্ডিকে শ্রীলঙ্কার সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়।
দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় আদম পর্বত। এটিও একটি দর্শনীয় স্থান। রাজধানী কলম্বোর ৪০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত আদম পর্বতের উচ্চতা ২ হাজার ২৪৩ মিটার। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ)-এর পায়ের ছাপ আছে। যদিও এই স্থানটি একইভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবম্বলীদের কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাঁরা মনে করেন, গৌতম বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন। মুসলমান এবং বৌদ্ধ উভয়েই সমানভাবে সম্মান করে হযরত আদম (আ) বা গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপ বলে।
পিন্নায়েল্লা অনাথ হাতির আশ্রম : বন উজাড়ের ফলে বা নানান রকমের জাতিগত দাঙ্গার কারণে অনেক হাতি তাদের আবাসন হারিয়েছে বা কোনভাবে আহত হয়েছে এই সব হাতিকে ৫-৬ মাসের জন্য সেবাযতœ, খাবার দাবার দেয়া হয় এই স্থানে। আছে পঙ্গু হাতিদের আলাদা ব্যবস্থা। এরপর হাতি নিজে নিজে চলাফেরা করার মতো এবং নিজেকে সুরক্ষার জন্য তৈরি হলে হাতিটিকে আবার বনে ছেড়ে আসা হয়। আর তার জায়গায় আসে নতুন কেউ।