ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার ভূমি পরিবেষ্টিত একটি ছোট্ট দেশ। ভারত ও চীনের মাঝে পূর্ব হিমালয় পর্বতমালায় এর অবস্থান। ভুটানের উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। ভুটান নামটি সংস্কৃতি শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে এসে থাকতে পারে। আবার অনেকের মতে ‘ভোটস-আন্ট’ থেকেও এসে থাকতে পারে, যার অর্থ ‘তিব্বতের শেষ’ বা ‘তিব্বতের দক্ষিণ’। ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে ভুটান বিভিন্ন নামে খ্যাত ছিলো। যেমন, লো মন, লো সেন্দেঞ্জং, লোমেন খাঝি ও লো মেন জং।
অতীতে ভুটান পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ১৬শ শতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯০৭ সাল থেকে ওয়াংচুক বংশ দেশটি শাসন করে আসছে। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভুটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে দেশটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। আর সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত ভুটান ভারতনির্ভর হয়ে আছে। তবে এখনও এটি বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির একটি। ভুটানের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে মাতৃভাষা জংকায় দ্রুক ইয়ুল বা বজ্র ড্রাগনের দেশ বলে। ভুটানের আকার, আকৃতি ও পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডের সদৃশ বলে দেশটিকে অনেক সময় এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিমালয় কন্যা ভুটান।
ভুটানের আয়তন ১৮ হাজার ১৪৭ বর্গমাইল (৪৬,৫০০ বর্গকিলোমিটার)। জনসংখ্যা ৭ লাখ ৫০ হাজার ১২৫ জন। রাজধানী থিম্পু। এই নগরীতে প্রায় ৮৫ হাজার লোক বাস করে। থিম্পু দেশের মধ্য-পশ্চিমাংশে অবস্থিত। অন্যান্য শহরগুলোর মধ্যে পারো, ফুয়েন্টশোলিং, পুনাখা ও বুমথং উল্লেখযোগ্য। ভুটানে বর্তমানে একজন ক্ষমতাশালী রাজার নেতৃত্বে উত্তরাধিকার ভিত্তিক রাজতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। ভুটানের বর্তমান রাজার নাম জিগমে খেসার নামগিয়াল ওয়াংচুক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। এদেশে ১৩০ সদস্যের পার্লামেন্ট টিসংদু বা জাতীয় পরিষদ আছে।
ভুটানের জনগণের সংখ্যাগুরু অংশ তিব্বতি বসতিস্থাপনকারীদের অধস্তন বংশধর। এদেরকে বলা হয় ভোটে। এর পরেই রয়েছে নেপাল থেকে আগত বসতিস্থাপনকারীদের অবস্থান। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপের মধ্যে রয়েছে হিন্দু এবং ভারতের আসাম রাজ্য ও বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আগত জনগোষ্ঠী। ভুটানের জাতিগত গ্রুপের হার ভোটে শতকরা ৫০ ভাগ, নেপালি ৩৫ ভাগ এবং দেশীয় উপজাতি ১৫ ভাগ। ভুটানের মানুষ বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলে। জংকা নামক একটি তিব্বতি ভাষা হচ্ছে জাতীয় ভাষা এবং স্কুলগুলোতে এই ভাষায়ই শিক্ষা দেয়া হয়। এখানকার নেপালিরা নেপালি ভাষায় কথা বলে। তিব্বতি বংশোদ্ভুত সকল ভুটানি বৌদ্ধধর্ম পালন করে। বৌদ্ধধর্ম ভুটানের সরকারি ধর্ম। ভুটানের নেপালি বংশোদ্ভুতদের বেশির ভাগই হিন্দুধর্ম পালন করে। এখানকার ধর্মাবলম্বীদের হার বৌদ্ধ শতকরা ৭৫ ভাগ এবং হিন্দু শতকরা ২৫ ভাগ।
ভুটানের হিন্দুরা ভারতীয় সীমান্ত বরাবর নিবিড় গ্রামগুলোতে বাস করে। তারা কাঁদার দলা ও পাথর দিয়ে চারকোণা বাড়ি নির্মাণ করে। তারা বন্যা, বণ্যপ্রাণী ও সাপ থেকে নিরাপত্তার জন্য উঁচু ভূমিতে বাড়ি নির্মাণ করে। মধ্য হিমালয় উপত্যকার ছোট গ্রামগুলোর অধিবাসীরা পাইন কাঠের ছাদযুক্ত আয়তকার পাথর পিন্ড দিয়ে তৈরি বাড়িতে বাস করে। পরিবারের সদস্যরা উপর তলায় বাস করে এবং নিচ তলা গবাদি পশুর গোয়াল ও গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করে। উঁচুতে উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য উপত্যকাগুলোতে মানুষ পাথরের প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট ছোট গ্রামে বাস করে। তিব্বতি বংশোদ্ভুত লোকেরা রঙিন কম্বলের তৈরি লম্বা, ঢিলেঢালা কোট পরে। এটা কোমরের কাছে কুঁচকানো থাকে এবং হাঁটু পর্যন্ত লম্বা।
এদেশের মানুষের গড় আয়ু পুরুষ ৫৫ বছর এবং মহিলা ৫৪ দশমিক ৫ বছর।
ভুটানে তিনটি প্রধান ভূমি অঞ্চল আছে। সমভূমি ও নদী উপত্যকা মিলে একটি অঞ্চল দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর অবস্থিত। এটি সমুদ্র স্তর থেকে প্রায় ১৫০ থেকে ৩০০০ ফুট উপরে অবস্থিত। এর গরম আর্দ্র আবহাওয়ায় কলা, টক ফল (আপেল, কমলা, নাসপাতি ইত্যাদি) ও ধান জন্মে। দ্বিতীয়ত, মধ্য-হিমালয় পর্বতমালা অঞ্চল সমভূমির উত্তরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি সমুদ্র স্তর থেকে ৫ হাজার থেকে ১৪ হাজার ফুট উপরে। এই অঞ্চলে মোটামুটি সহনীয় আবহাওয়ায় ওয়াশিজ, ওক, সাফিদার, চিনার ও উইলো গাছ জন্মে। তৃতীয়ত, উঁচু বা গ্রেট হিমালয়ের পর্বতমালা অঞ্চল দেশের একেবারে উত্তরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি সমুদ্র স্তর থেকে ২৪ হাজার ফুট উপরে। উল্লেখ্য, হিমালয় পর্বতমালায় ১৪ হাজার ফুট উপরের অংশে আবহাওয়া খুবই ঠান্ডা। এই অঞ্চলের কিছু কিছু অংশ সারা বছর তুষার ও হিমবাহে ঢাকা থাকে। প্রধান পার্বত্য রেঞ্জগুলো ভুটানের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে বিস্তৃত। নদীগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়ায় সেখানে কতকগুলো উর্বর উপত্যকা গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রীষ্মকালীন মওসুমি হাওয়া এই অঞ্চলে প্রায় ৮৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত বয়ে আনে।
বহির্বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ভুটান প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্য। এখানে বহু দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। ভুটানের প্রায় ৭০% এলাকা অরণ্যাবৃত। এই অরণ্যই ভুটানের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
ভুটানের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা নুলট্রাম এবং এর বিনিময় হার ভারতীয় রুপির সাথে সম্পর্কিত। ভুটানের অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতিগুলির একটি। এটি মূলত কৃষি ও বনজ সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। ভুটানের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% এই দুই ধরনের পেশায় জড়িত। ফুয়েন্টশোলিং শহরটি দ্বারা ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভুটানের ব্যবসা বাণিজ্য চলে।
বেশিরভাগ ভুটানি কৃষক ও পশুপালক। অধিকাংশ কৃষক উর্বর উপত্যকাগুলোতে এবং পার্বত্য ঢালের সেচ এলাকায় ফসল ফলায়। ভুটানে আবাদি জমির পরিমাণ মোট ভূমির মাত্র ২ শতাংশ। বার্লি, ধান ও গম প্রধান ফসল। উঁচু পার্বত্য এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও ইয়াক পালে। ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কাঠ, জলবিদ্যুৎ, জিপসাম ও ক্যালসিয়াম কারবাইড। দক্ষিণ ভুটানে কিছু কয়লা উৎপাদিত হয়। ভুটানের বাণিজ্য প্রধানত ভারতের সাথে হয়। ভুটান কয়লা ও চাল রফতানি এবং জ্বালানি তেল ও চিনি আমদানি করে।
ভুটান জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা এবং সার্কের সদস্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২২টি দেশের সাথে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী চুক্তির আওতায় ভারত ও ভুটানের নাগরিকরা পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়াই শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একে অপরের দেশে ভ্রমণ করতে পারে। চীনের সাথে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
ভুটান ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। ঐ বছর চীন দেশটির একাংশ দাবি করে। ভুটান তখন ভারতের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করে এবং তার অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং গণস্বাস্থ্য স্থাপনা আধুনিকায়ন করার কর্মসূচি শুরু করে।
১৯৭২ সালে রাজা জিগমে দোরজি ওয়াংচুক মারা যান এবং তার পুত্র জিগমে সিংগে ওয়াংচুক মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার স্থলাভিষিক্ত হন। দীর্ঘ ৩৪ বছর দেশ শাসনের পর ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করার ঘোষণা দেন এবং তার অক্সফোর্ড পড়–য়া পুত্র বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগিয়াল ওয়াংচুক ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
২০০৮ সালের ১৮ জুলাই ভুটানের সংসদ একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক দিন থেকে ভুটানে পরম রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে এবং ভুটান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়।
ভুটান একটি আকর্ষণীয় পর্যটন অঞ্চল। রাজধানী থিম্পু আকর্ষণীয় ও নান্দনিক সৌন্দর্যের অধিকারী একটি নগরী। এই স্থানটি দেশের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। এখানে আছে সিমতোখা জং। এটি ১৬২৭ সালে তৈরি থিম্পু ভ্যালির গেটওয়ে বা প্রবেশপথ। এই অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ রিগনে স্কুল ফর জঙ্ঘা অ্যান্ড মোনাস্টিক স্টাডিজ এবং স্টেট কার্ভিংস। রাজধানী থিম্পুর প্রাণ থিম্পু জং। এটি তৈরি হয় ১৬৬১ সালে। জাতীয় পরিষদ, রাজার সিংহাসন কক্ষ, সরকারি ডিপার্টমেন্ট এবং সেন্ট্রাল মোনাস্টিক বডির গ্রীষ্মকালীন সদরদ ফতরের দেখা মিলবে এখানে।
থিম্পু শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুনাখা। এখান থেকে হিমালয় দেখা যায়। ভুটানের সবচেয়ে উর্বর উপত্যকা পুনাখা। এখানে পুনাখা জং, ফো ছু এবং মো ছু নদীও দেখতে পাওয়া যায়। পুনাখা ভুটানের প্রাক্তন রাজধানী।
পারো ভুটানের আরেকটি দর্শনীয় শহর। এটি পারো উপত্যকায় অবস্থিত। পারো একটি ঐতিহাসিক শহর যেখানে বিভিন্ন পবিত্র স্থান এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ছড়িয়ে আছে। এখানেই ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। পারোর বিমানবন্দরকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সংকটপূর্ণ বাণিজ্যিক বিমানবন্দর’ বলা হয়। এর মাত্র একটি রানওয়ে আছে। উড়োজাহাজকে অ্যাপ্রোচে ৫৫০০ মিটার হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ পার হয়ে ১৯৮০ মিটার রানওয়ে দিয়ে যেতে হয়। এলাকাটির গড় উচ্চতা অতিমাত্রায় কম হওয়ায় এর প্রতিকূলতা দ্বিগুণ কঠিন। ফলে মুষ্টিমেয় সংখ্যক বৈমানিক এখানে উড়োজাহাজ চালানোর অনুমতি পান। বসন্তে পারোর রূপ হয়ে ওঠে এক কথায় অসাধারণ। এখানে রয়েছে পারো জং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম। এ অঞ্চলের সব থেকে বড় আকর্ষণ টাইগার্স নেস্ট।
ভুটানে আকাশ ও স্থল উভয় পথেই যাওয়া যায়। ভুটানে যেতে প্রথমেই ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হবে যা ঢাকার গুলশান শাখা থেকে করিয়ে নিতে হবে। সড়ক পথে গেলে ঢাকা থেকে বাসে সোজা বুড়িমারি সীমান্ত। সেখানে ইমিগ্রেশন শেষ করে ঢুকে পড়তে হবে ভারতে। অতঃপর দুই সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভারতীয় ভূমি পাড়ি দিয়ে ভুটান-ভারত সীমান্তে জয়গাঁও ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিস এবং সেখান থেকে এক্সজিট সিল লাগিয়ে সোজা চলে যান ভুটান। ভুটানে ঢুকেই সীমান্ত শহর ফুয়েন্টশোলিং থেকে নিতে হবে এন্ট্রি পারমিট। ভুটান-ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত, সুতরাং যখন খুশি যাওয়া-আসা করা যায়। কোন সমস্যা নেই। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবং ভুটানের সময় একদম এক।