সুইডেনে আমার প্রথম প্রবাস ১৯৮২ সালে। আমার স্বামী কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী সঙ্গী ছিলেন। বড় মেয়ে রুবার শ্বশুরালয় সুইডেনে। অধ্যাপক শাহেদ আলীর ভ্রমণপিপাসু মন সুইডেনে মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে একদিনের জন্যও বিশ্রাম করেননি। ধরতে গেলে গোটা সুইডেনের আনাচে-কানাচে অনেক দর্শনীয় জায়গায় তিনি ঘুুরে বেড়িয়েছেন। মনের দরজা খুলে দিয়ে চোখের আয়নায় তুলে নিয়েছিলেন সুন্দর মনোহর দেশ সুইডেনের জলছবি। সেইদিনের সেই মনোহর স্মৃতিকথাগুলো আজো মনের কোণে ঝিকমিক করে। ছুটি না থাকাতে সেবার ১৫ দিনের মাথায় সে হিরণ¥য় স্মৃতিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল। যদিও অধ্যাপক সাহেবের এতো অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল না।
১৯৮৭ সাল, তখন আমি চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। খবর পেলাম মেয়ে হাসপাতালে। একটি পুত্রসন্তানের জননী হয়েছে। মন কোনো বাধা মানলো না, অসুস্থ অধ্যাপককে ছেলে এবং বউয়ের জিম্মায় রেখে বিদেশ যাওয়ার সব বাধা ডিঙিয়ে প্রস্তুতি সেরে নিলাম। সৌভাগ্যক্রমে সঙ্গী পেয়ে গেলাম আমার ইডেন কলেজের সহকর্মী জোহরা আপাকে। তিনিও সুইডেন যাচ্ছিলেন স্বামীসহ ছেলের কাছে।
১৬ জুন ১৯৮৭ বিকাল ৪টায় আমার ফ্লাইট। বিমানবন্দরে গিয়ে জোহরা আপার সাথে দেখা হয়ে গেলো। ভ্রমণে আনন্দ আছে উল্লাস আছে। ভয়ভীতিও কম না। কিন্তু এবার তেমন ভয়ভীতি অনুভব করলাম না। সেই প্রথমবার সুইডেন যাওয়ার ভ্রমণের স্মৃতিকথা এখনো মনকে আবেগে উদ্বেল করে তোলে। নাম না জানা বনজ ফুলের সুগন্ধের মতো মনকে সুবাসে ভরিয়ে রেখেছে।
জীবননদী যখন মরণ মোহনার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অদৃশ্য পারাবারে ভ্রমণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এমন সময় তাগিদ এসেছে ভ্রমণ অনুরাগী কবিভাই মোশাররফ খান ভাইয়ের কাছ থেকে। কিছু ফেলে আসা মধুময় স্মৃতি সোনামণিদের জন্য লিখে দিতে।
তারই প্রীতিময় ভালোবাসার তাগিদে লিখতে বসলাম আমার দ্বিতীয় বার সুইডেন ভ্রমণের কিছু কথাচিত্র। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমার যাত্রা শুরু হলো। পথে জোহরা আপাদের সান্নিধ্যে দূরত্বের কষ্ট, একাকিত্বের অসহায়ত্ব একটুও অনুভব করিনি। নির্ভার মন নিয়ে বাতাসের ভেলায় ভাসতে ভাসতে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আকাশ আর পৃথিবীজুড়ে বিশাল ব্যাপ্তি আর সর্বব্যাপী শূন্যতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অপার্থিব অনুভূতি। পেঁজা পেঁজা তুলার মতো ভাসমান মেঘপুঞ্জে বিদায়ী সূর্যের সোনালি আভা এক অলৌকিক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করছে। আমি অন্তহীন শূন্যতার মধ্যে মনটিকে মেলে ধরে জানালার পাশের সিটে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি।
আমার পাশের সিটে জোহরা আপা, পরের সিটে তার স্বামী। আগে পিছে বহু মানুষের উপস্থিতি। কোনটাই আমার চিন্তা-চৈতন্যের মধ্যে নেই। আমি বিস্মিত পুলকিত মনে মহান মহিমাময় আল্লাহর অসীম কুদরতের বিপুলতায় মহাবিষ্ট হয়ে আছি।
এরই মধ্যে এয়ার হোস্টেসদের খাবারের ট্রলি হাতে যাত্রীদের কাছে আসা-যাওয়ায় আমার ধ্যান ভাঙলো। কতক্ষণ পরে ঘোষণা এলো (ঋধংঃবহ ঃযব ইবষঃ) সবাই আড়মোড়া ভেঙে বোম্বে এয়ারপোর্টে নামার প্রস্তুতি নিলাম।
বোম্বে এয়ারপোর্টে নেমে আমি ও জোহরা আপা এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ চত্বরে ঘুরে বেড়ালাম এবং সময় শেষে উঠলাম প্লেনে। তারপর করাচি, তাসখন্দ এবং মস্কো পাড়ি দিলাম। প্রত্যেক এয়ারপোর্টে বিমান থামলেও অনেকে নামলেও আমরা সিটে বসেই ছিলাম। একসময় সুদীর্ঘ ভ্রমণের সমাপ্তি হলো। গন্তব্যের বিমানবন্দর সুইডেনের স্টকহোমের মাটিতে বিমান নামলো। মনে আমার অবিশ্বাস্য পুলকিত অনুভূতি। কিন্তু ভীষণ কনকনে ঠান্ডা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, হাড় কাঁপানো শীত। এরই মধ্যে কার্পেট মোড়া করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে। দ্রুত এই ঝামেলা শেষ করে এসে পড়লাম বাইরের লাউঞ্জে। মাল টানার জন্য খালি ট্রলি নিয়ে মাল আসার জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। জোহরা আপারা আমার আগেই মাল আসার জায়গায় পৌঁছেছেন। আমি একদিক মাল আসার জায়গায় চোখ রাখছি অন্য চোখে বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের দিকে তাকাচ্ছি। অনেক উৎসুক মুখের ভিড়। আপনাপন জনদের খুঁজতে চেষ্টা করছে সবাই।
তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি এসেছি। রুবা ও উলফকে খবরও দিইনি। ভেবেছি জোহরা আপার সাথে তার ছেলের বাসায় উঠবো পরে ফোনে আমার আসার খবর রুবাকে জানাবো। মিনেট দশেক ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাল এলো। চট্টগ্রাম থেকে আগত মুহসিন নামের এক তরুণ আমাকে মাল নামাতে সাহায্য করলো। মাল ট্রলিতে তুলে বিমানবন্দরের বাইরে এসে পড়লাম। বিষন্ন আবহাওয়া ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। জোহরা আপার সুইডেন প্রবাসী ছেলে রাস্তার ওপার থেকে গাড়ি আনতে গেছে। এমন সময় অবাক করে দিয়ে এক সুদর্শন ছেলে আমাকে বলে-খালাম্মা আপনার মাল কই? আমিতো আপনাকে নিতে এসেছি। জিজ্ঞেস করে নাম জানলাম, ওর নাম কাদের। মামী ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা জাহানারা। আমার অত্যন্ত আপনজন। কাদের আমাকে নেবে শুনে জোহরা আপা ভীষণ হইচই শুরু করে দিলেন। আপাতো আমাদের সাথে এসেছেন। তাই আমাদের সাথে যাবে। কিন্তু কাদের নাছোড়বান্দা। সে আমাকে তার সঙ্গে নেবেই। শেষ পর্যন্ত জোহরা আপাকে রাজি করিয়ে আমি কাদেরের সাথেই গেলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে কাদেরের বাসার দূরত্ব হলো প্রায় পঁচিশ মাইল। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই রাস্তার দু’ধারে সবুজের শোভা সুইডিশ জাতির নিপুণ হাতের পরিচর্যা দেখতে দেখতে গাড়ি এসে পৌঁছলো কাদেরের বাসায়। এলাকাটির নাম রিনকেবি, রূপকথার নিঝুমপুরীতে যেনো আমি এসে ঢুকলাম। বাসা খালি ওর। মেয়ে এবং স্ত্রী স্কুলে। মেয়ে নার্সারিতে পড়ে, মা ঐ সেকশনের শিক্ষিকা। কাদের আমাকে সোফায় বসতে দিয়ে অত্যন্ত যতœ করে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। এতদূর জার্নি করে এসেছি অথচ অবাক কান্ড এতোটুকুও ক্লান্তি নেই। চারিদিকে শান্ত সমাহিত পরিবেশ। সেই সঙ্গে অপরূপ সুন্দরের ছোঁয়া আমার মন প্রাণ ভরিয়ে দিচ্ছে। আমাকে চা দিয়ে কাদের চলে গেলো ওর স্ত্রী-সন্তানদের আনতে। আমি একা ঘরে গোসল সেরে অবাক নয়নে তার পরিপাটি সুন্দর ঘরদোর দেখছি। যেদিকে তাকাচ্ছি সে দিকেই সুন্দর আর সুন্দর। কাদেরের ঘরের সামনে, পেছনে, জানালায়, বসার ঘরের সামনের টেবিলে, খাওয়ার ঘরের র্যাকে টবে টবে ছোট ছোট বাহারি ফুলের মেলা। মনে হচ্ছে আমি যেনো অনিন্দ্যসুন্দর এক ফুল বাগিচায় বসে আছি। অল্প সময়ের মধ্যে কাদের তার স্ত্রী রিমা ও কন্যা চৈতিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। গোলগাল ফর্সা চেহারার মেয়ে রিমা। বয়স আনুমানিক বিশ থেকে পঁচিশের মাঝামাঝি। পরনে জিন্সের প্যান্ট, গেঞ্জি আর ওভার কোট। ঘরে ঢুকে একমুখ হাসি নিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। আমার মনেই হলো না দূর দেশে সম্পূর্ণ অপরিচিত জনদের মধ্যে আমি আছি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কথাবার্তায় রিমা আমার মন জয় করে নিলো।
যাকে দেখতে আমি এতদূর এসেছি। এদের আন্তরিকতায় একেবারে তাদের কথা ভুলে বসে আছি। কাদের আমার কাছ থেকে রুবার ফোন নাম্বার নিয়ে দ্রুত যোগাযোগ করিয়ে দিলো। রুবা অবাক হয়ে বলে, আম্মা আমিতো ভাবতেই পারি নাই আপনি একাই সুইডেনে আসতে পারবেন। রুবা থাকে স্টকহোম থেকে অনেক দূরে সটিনাস নামক জায়গায়। সে বলল, আমি এতো দূরে থাকি, কিভাবে আপনাকে আনবো। একটা দিন ঠিক করে তবেই না আসতে হবে আপনাকে আনতে। ফোনে কথা সারতেই দেখি টেবিলে খাবার রেডি। অল্পক্ষণের মধ্যেই রিমা রান্না শেষ করে ফেলেছে। খাসি, মুরগি, মাছ কোনটাই বাদ নেই খাবার টেবিলে। খাওয়ার পর কাদেরকে রুবার অসুবিধার কথা বলতেই বললো দরকার নাই ওর আসার। আমিই পৌঁছে দিব আপনাকে স্টেশনে। এখানকার রেল ভ্রমণ খুবই আনন্দের, আপনি একাই যেতে পারবেন। বেলা শেষের খবর পাচ্ছি শুধু ঘড়ির কাঁটায়। বাইরে কিন্তু সূর্যের আলোর কমতি নেই। দিন শেষ হয়েছে বুঝারও উপায় নেই।
সন্ধ্যার পর দেখলাম কাদেরের কাছে কয়জন বাংলাদেশি ছেলে এলো। জিজ্ঞেস করে জানলাম এরা সবাই সামার জব করতে এসেছে সুইডেনে। এই মৌসুমে মাস তিনেক কাজ করে লাখ খানেক টাকা নিয়ে দেশে ফিরবে। এসব ছেলেদের বয়স বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। প্রয়োজনের তাগিদে দেশ ছেড়ে বিদেশে এসে এক ধরনের অড জব করে। কাদের বলে খালাম্মা এসব জবে কোনো গৌরব নেই। কিসের নেশায় এরা বিদেশে আসে আমি বুঝি না। সে আরো বলে আমিও এক ধরনের মোহ নিয়ে সুইডেন এসেছি। ভালো একটা জব পেলাম তাই থেকে গেলাম। তবে দেশে থাকার মতো একটা জায়গা করতে পারলে চলে যাবো।
রাত দশটা কিন্তু বাইরে চারিদিকে আলোর খেলা। বুঝার কোন উপায় নেই রাত হয়েছে। কাদের আস্তে আস্তে রুমে ঢুকে জানালার কালো পর্দা নামিয়ে দিয়ে বললো, খালাম্মা ঘুমান। আমাদের দেশে এখন রাত। এদেশে সূর্য ডুবতে অনেক সময় লাগে। আমি বললাম, আমি নামাজের সময় কিভাবে ঠিক করবো? আমার কথা শুনে সে একটা নামাজের চার্ট এনে দিলো। বললো এখন রাত দশটা মাগরিবের নামাজের সময়। এশার হবে রাত বারোটায়। সকালের নামাজ পড়তে পারবেন যদি আপনি রাত দুইটায় ওঠেন। আমি অবাক হয়ে রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। রিমা হাসছে। পরদিন সকাল পাঁচটায় যখন ঘুম ভাঙে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মাথার উপর সূর্য হাসছে। কিন্তু গুরুগম্ভীর শান্ত প্রকৃতি। অসীম নীরবতায় সমাহিত চারদিক। প্রকৃতি থেকে উৎসারিত হচ্ছে এক সম্মোহনী সঙ্গীত। আমি কান ভরে এ সঙ্গীত শুনছি আর মন ভরে উপলব্ধি করছি। এমন সময় রিমা ঘরে ঢুকে বলে খালাম্মা আমি এখন স্কুুলে যাবো। আপনার ছেলে সারারাত অফিস করেছে। একটু পর ঘরে ফিরবে। নাস্তার সরঞ্জাম টেবিলে দেয়া আছে। আপনি খুশি মনে খেয়ে নিবেন বলে চৈতিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কাদের ঘরে ফিরলো। কোন বিশ্রাম না নিয়েই চা বানিয়ে দেয় আমাকে। দু’জনেই চা, নাস্তার পর্ব শেষ করে ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম। সামনে কাচের জানালা ভেদ করে দেখা যাচ্ছে পাইন ও ওক গাছের বিপুল শোভা। আকাশ মেঘলা, পাতাগুলোর ন¤্র কাঁপন, সারা প্রকৃতি নীরবে, নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে যেনো। কয়েকটি দোয়েল পাখি গাছের তলা থেকে কী যেনো কুড়িয়ে খাচ্ছে। কাদের অল্প স্বল্প গল্প করে ঘুমাতে গেলো। সরকারি তত্ত্বাবধানে চালিত একটি সংস্থায় চাকরি করে সে। এই সংস্থা সুইডেনের সব মানসিক রোগীদের হিসাব রাখে। রোগের মূল কারণ জানতে চেষ্টা করে এবং সে হিসেবে চিকিৎসা দেয়। প্রয়োজনে পরিবারকে আর্থিক সুবিধা দেয়, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখে। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। ফোনটি এসেছে জোহরা আপার কাছ থেকে। কি আপা কেমন আছেন? আমাদের সাথে আসলেন নাতো। বললাম কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে দেখে আসবো আপনাকে। জোহরা আপার সাথে কথা বলা শেষ করতেই রুবার ফোন বেজে উঠলো। ভীষণ ক্লান্ত সে। ফোনেই আমি তার আভাস পাচ্ছি। সুইডেনে আছি আমি। অথচ তার সাথে দেখা হচ্ছে না। এ জন্য তার মন খুব খারাপ। আমারও কম না।
বাইরে হিমেল হাওয়া, টিপটিপ বৃষ্টি। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে বসে আছি। বিকালে কাদের, রিমা, চৈতি আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো। প্রথমে জোহরা আপাকে দেখে আসলাম। পরে গেলাম ইডেন কলেজের আমার এক পুরনো ছাত্রী মমতাজের বাসায়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে। সম্প্রতি তার ছোট ভাইকেও নিয়ে এসেছে। ভাইটি নাকি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ছিলো। আরো সুখ ও আরামে থাকার জন্য সুইডেনে আসা। আমার ছাত্রী মমতাজ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায় আমাকে অভিভূত করে দিলো। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই খুব ধার্মিক। হাসতে হাসতে মমতাজ বললো আপা আমরা দু’জনেই সব রোজা করেছি। আমি অবাক হলাম। সুইডেনের মতো জায়গায় যেখানে আঠারো ঘণ্টায় সন্ধ্যা হয়। সেখানে রোজা রাখাটাইতো ভীষণ কষ্টের। বেশির ভাগ লোকই দু’তিনটা রেখে ছেড়ে দেয়। পুরো মাস রাখতে পারে না। মমতাজের কথায় খুবই খুশি হলাম। সুইডেনের সময় রাত বারোটা। গল্প, গুজব, খানা-পিনা শেষ করে আমরা উঠে পড়ি। সে আমাকে ছাড়ার পাত্র নয়। কথা দিতে হলো দেশে ফেরার আগে দুইদিন থাকতে হবে। সুন্দর নীরব রাস্তা শহরময় বিজলি বাতির খেলা আর শিলাময় পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা ঘরে ফিরলাম।
১৯ জুন ১৯৮৭। সকালবেলা। আকাশে প্রসন্ন হাসির ছটা। নীরব চারিদিক কোথাও মানুষের গতিগম্য নেই। প্রকৃতি যেনো অনাদিকাল থেকে বিশ্বপিতার ধ্যানে মগ্ন এখানে। রিমা বেরিয়ে গেলো চৈতিকে নিয়ে স্কুলে, বলে গেলো ফিরবে ১টায়।
বারোটার দিকে এলো আমার এক সহকর্মী অধ্যাপিকা ফিরোজা। চট্টগ্রামে অধ্যক্ষ হওয়ার আগে আমি ইডেন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলাম। বিভাগীয় শিক্ষিকাদের সাথে পারিবারিক সম্প্রীতির মধ্যে দিয়েই দিন কেটেছে। বদলি হওয়ার পরেও সে সম্প্রীতি অটুট আমাদের। সম্প্রতি সেও সুইডেন এসেছে তার এক আত্মীয়ের বাসায়। এখান থেকে লন্ডন হয়ে সে বাংলাদেশে ফিরবে। তার সাথে এসেছে মেয়ে কান্তা, ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল ও তার স্ত্রী পিংকী। আমাকে সাথে নিয়ে স্টকহোম বেড়াবে এই আসায় আমাকে নিতে এসেছে। খুশি হলাম আমার প্রতি তার ভালোবাসা দেখে। রাজার বাড়ি, পার্লামেন্ট ভবন, সিটি প্যালেস, শপিং সেন্টার ঘুরে দেখলাম। দুপুরে পুরনো শহরের এক রেস্টুরেন্টে খাওয়ালো তরুণ ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল। ভীষণ ক্লান্ত তারপরও যেতে হলো আবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দাওয়াত এসেছে আমার ভাই কর্নেল হেসাম উদ্দিনের ভায়রা ভাই এখানকার ইকোনোমিক কাউন্সিলর মেজর আওলাদ হোসেনের বাড়িতে। ওখানে রাতের খাবার শেষ করে ফেরার পথে কাদের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় দেখালো। লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আমার দু’তিনটি ছবি তুললো। তারপর ফিরে এলাম কাদেরের বাসায়।
২০ জুন ১৯৮৭। আজকে চলে যাচ্ছি মেয়ে রুবার বাসা সটিনাসে। এই স্টকহোম থেকে প্রায় চারশ কিলোমিটার দূরে। আমার জামাই সেখানকার এয়ার বেসের আবহাওয়াবিদ। কাদের স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনে চারটার সময় নিয়ে আসে আমাকে। এখান থেকে সটিনাস যেতে হবে একা একা। রিমা, চৈতি, কাদের এবং এক বাংলাদেশি ছেলে মোহন আমাকে তুলে দিলো ট্রেনে। কাদের আমাকে কিছু সুইডিশ ক্রুনার হাতে দিয়ে বললো সঙ্গে রাখেন, পথে প্রয়োজন হতে পারে। সুন্দর এক ট্রেনের যাত্রী আমি। ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা নেই বললেই চলে। যে ক’জন যাত্রী আছেন, সবাই পৌঢ়া প্রায়। ট্রেন এগোচ্ছে। নতুন পথের যাত্রী আমি। সবকিছুই আমার কাছে নতুন। যদিও অনেক দেশের অনেক ট্রেনের যাত্রী হয়েছি অনেকবার। কিন্তু এতো সুন্দর ট্রেন আগে কখনো পাইনি। ট্রেনের সিট নম্বর বত্রিশ। মনের সুখে পা এলিয়ে দিয়ে মনোহর রূপের খেলা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে নদী, মাঝে মাঝে বিশাল অরণ্যের বিশালতায় হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামছে সময় মতো, ছাড়ছেও সময় মতো। কিন্তু মানুষের ওঠানামা খুবই কম। রুবা আমাকে বলে দিয়েছিলো। আম্মা একা আসছেন বলে ভয় পাবেন না।
আপনি যে স্টেশনে নামবেন, তার আগের স্টেশনে উলফ গিয়ে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবে। আমার মনে হচ্ছে সেই স্টেশনে এসে গেছি। মনে মনে নার্ভাস হচ্ছি। ভাবছি, যদি উলফ না আসে। এরই মধ্যে একবার বাথরুমে যেতে হলো। বাথরুমে লোক আছে কি না বুঝতে পারছি না। বাথরুমের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে এক ফিনিশ দম্পতি। সঙ্গে প্যারাম বুলেটরে একটি ছোট শিশু। তাদের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতেই ফিনিশ মহিলাটি এসে বাথরুমের দরজা খুলে দেয়। ভেতরে গিয়ে পড়লাম আরেক মুুসিবতে। পানি কোথায়? চারিদিকে সুন্দর সুন্দর কাগজ পরিপাটি করে সাজানো, মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো। আমি বেরিয়ে এলাম।
ফিনিশ দম্পতিকে বললাম ডরষষ ুড়ঁ যবষঢ় সব ঃড় মবঃ ধ ধিঃবৎ?
মেয়েটি বাথরুমে ঢুকে এক জায়গায় চাপ দিলো। আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম। এতো দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। কিন্তু বাথরুমের এতো সুন্দর কায়দা-কানুন কোথাও দেখিনি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সিটে বসতে না বসতে আমার গন্তব্যে যাওয়ার আগের স্টেশন এসে গেলো। হাসি মুখে গাড়িতে উঠে এলো উলফ। মুচকি হাসি দিয়ে কাছে এসে সে আমাকে অর্ভ্যথনা জানালো। পাশের খালি সিটে বসতে বসতে বলে আম্মা আপনার লাগেজ কোথায়? এক্ষুনি আমাদের নামতে হবে। পরক্ষণেই ট্রেন স্টেশনে এসে গেলো। স্টেশনের নাম ফল শপিং। বিরাট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, সুন্দর ও ছিমছাম । কিন্তু জনশূন্য। নামার যাত্রী শুধু আমরা দু’জন। স্টেশনের বাইরে উলফের গাড়ি অপেক্ষা করছে। এখানে গাড়ি রেখে এক স্টেশন এগিয়ে গিয়েছে আমাকে রিসিভ করার জন্য উলফ। গাড়িতে উঠলাম, যাবো সটিনাসে রুবার বাড়িতে। এখানকার কর্মচারী আর তাদের পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের কেউ আসতে পারে না এই এলাকায়। আমাকে আনতে গিয়ে অনুমতি সংগ্রহে উলফের অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। উলফ গাড়ি চালাচ্ছে, রাস্তার দু’ধারে ওট, সরিষা, গমের সুবিস্তৃত ক্ষেত। মাঝে মাঝে মনোহর চোখ জুড়ানো সবুজের মধ্যে নয়নাভিরাম লাল আর সাদা রঙের কটেজ টাইপের ফার্মারদের বাড়ি এবং খামার বাড়ি। কোথাও কোথাও সবুজের সীমানা মিলিয়ে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত। পাইন, ওক, বিচ গাছের সুবিস্তৃত বনের মধ্য দিয়ে সুন্দর প্রসারিত রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে নানাদিকে। পথে-ঘাটে কোন মানুষের চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে দু’চারটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে মানুষসহ। নইলে বিরান মুল্লুক। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছালাম রুবার বাড়ির দোরগোড়ায়। সুইডেনের আকাশে তখনো সূর্যের ছড়াছড়ি। আমার দেশের জোহর শেষের ফাল্গুনি চেহারা, যাকে দেখার জন্য এতোদূর পাড়ি দিয়ে এসেছি। সে কেমন হয়েছে ভাবতে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি আমাকে অভিভূত করে তোলে। ঘরে ঢুকতেই রুবা আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। রুবা অনেক শুকিয়ে গেছে চেহারা মলিন। বললাম, এতো শুকিয়ে গেছিস কেন? সে বললো, অপারেশনের সময় অনেক ইনজেকশন দিয়েছে। যার কারণে এমন মলিন দেখাচ্ছে। বাচ্চা কই জানতে চাইলাম, বললো-এখন ঘুমাচ্ছে তার সিটে। এতো দূর থেকে এসেছেন, আপনি এখন বিশ্রাম করেন আম্মা। পরে ঘুম ভাঙলে দেখবেন। আমার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি ছিমছাম রুম। আমাকে টেনে এনে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, এটা আপনার জন্য। আপনি আসবেন শুনে আমি আর উলফ সাজিয়ে রেখেছি। পছন্দ হয়েছে আপনার? আমার কোনো ভাষা নেই। কী উত্তর দিবো বুঝতে পারছি না। আমি নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমাকে রুমে রেখে বেরিয়ে গেলো। একটু পরেই ফুটফুটে সুন্দর একটি বাচ্চা এনে আমার কোলে দিলো। সঙ্গে বাচ্চার বাবা এসেও ঘরে ঢুকলো। সারা মুখে তাদের ছড়িয়ে আছে একটা স্বর্গীয় আনন্দ, উল্লাস। ছেলের বাবা, হাসতে হাসতে বললো আম্মা, ঞযরং ষরঃঃষব নড়ু রং ধষধিুং ংষববঢ়রহম, ও ধস ধষধিুং ষড়ড়শরহম এই ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে তাদের কী যে আনন্দ আমার বলার ভাষা নেই। বিয়ের নয় বছর পর তাদের প্রথম সন্তান। এই সন্তান তাদের কাছে যেমন কাক্সিক্ষত তেমনি আমার কাছেও। তাইতো ছুটে এসেছি সুদূর উত্তর দেশে নাতিকে দেখার জন্য। এই নির্জন, নীরব দেশে যেখানে কথা বলার একটা মানুষ নেই সেখানে রুবা আমাকে পেয়ে তার আনন্দের শেষ নেই। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতো কথা যে সে বলতে চায়। সেখানে সে আমাকে পেয়ে আনন্দে আতিশয্যে কথার ফুলঝুরি ঝরাচ্ছে অবিরাম। কতো কথাই না সে জানতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন এমনকি কাজের লোকদের। সে বেশ দেরিতে মা হয়েছে এই খবরে আত্মীয় স্বজনের প্রতিক্রিয়া কী তাও সে জানতে উৎসুক। তার কোনো আদি থেকে অন্ত্য নেই। স্বজন, স্বদেশ, পাড়া প্রতিবেশী, কাজের লোক সকলের প্রতি সে উৎসুক। সবকিছুর খবর জেনে তার একাকিত্ব দূর করতে চায়। সে মা হয়েছে এই খবরে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তাই বেশি জানার প্রতি সে উৎসুক তা আমি লক্ষ করলাম।
সটিনাস সুইডেনের বড় এয়ার বেস। কিন্তু প্রকৃতি বড় বেশি নীরব। বড় বড় বৃক্ষ। হাজার পাখির সুরেলা কণ্ঠস্বর। এই গাছ থেকে ঐ গাছে ছুটাছুটির দৃশ্য সুন্দর পরিবেশ। বিমান বাহিনীর অফিসারদের সুশৃঙ্খল জীবন, ঘরের সামনে পেছনে হাজার রকম ফুলের বাহার। প্রথম কয়দিন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। পরে আস্তে আস্তে আমি হাঁপিয়ে উঠি। বাংলাদেশের মেয়ে আমি। সারাজীবন হইচই, হট্টগোল, আত্মীয়স্বজনের আসা যাওয়ার মধ্যে, মানুষের কলরব এর ভেতরের মধ্যে দিন কাটিয়েছি। এখানে সারাদিনেও একজন মানুষের সাক্ষাৎ মিলে না। এমন সুন্দর ছিমছাম রাস্তা ঘাট অথচ মানুষ দেখা যায় না একটাও। সুনসান নীরবতার মধ্যে গহিন অরণ্যানীর গভীরে রূপময় এক জগতে আমি যেন নির্বাসিতা, আমার বিষণœতা, আমার অস্থিরতা দেখে মেয়ে জামাইও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যাকে দেখার জন্য এতদূর পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছি। তার প্রতিও বেশি মনোযোগী হতে পারছি না।
আমার বিষণœতা কাটাবার জন্য একদিন জামাই আমাকে নিয়ে সটিনাস থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে প্রতি মাসের শেষ বুধবার বসা একটা গ্রাম্য মেলায় নিয়ে যায়। ওরে বাবা, এলাহি কান্ড এতো মানুষ এখানে। উলফ আমাকে বললো, ওরা অনেক দূর দূর থেকে আসে সুইডেনের ঐতিহ্যবাহী জিনিস কিনতে। মেলায় ঘুরে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করলাম। কিছু কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনলাম। মেলার জিনিসপত্র দামি, সুন্দর হলেও মেলার জায়গাটি আমাদের দেশের মতোই। এই ধরনের মেলায় আমরা শৈশব কালে প্রায়ই যেতাম। প্রতি বছর আমাদের গ্রামের বাড়ি বড় পুকুর পাড়ে পহেলা বৈশাখে এখনো মেলা বসে। সটিনাস আসার পর নির্জনতার দ্বীপে বন্দী আমি। জনাকীর্ণ মেলা ঘুরে এসে বেশ হালকা লাগছে। আমার একাকিত্ব কাটানোর জন্য উলফ ও রুবার চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু ছোট বাচ্চা আর নিজেদের কাজের জন্য আমাকে দূরে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে না। আমি সটিনাস এসেছি ২০ জুন। দেখতে দেখতে সাতদিন পার হয়ে গেলো। বিকালে আমি, রুবা, উলফ ও বাচ্চাসহ সটিনাসের পিচঢালা রাস্তার সারিবদ্ধ গাছের মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে এলাম হারবারে। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। ছোট ছোট প্রমোদতরী হারবারের ঘাটে বেঁধে রাখা। কোনো কোনো জায়গায় গাড়ি পার্ক করা। অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ গাড়ি রেখে প্রমোদতরীতে দূর দ্বীপে চলে গেছে সপরিবারে আনন্দ উপভোগের জন্য। এই নির্জন জায়গায় এয়ার পোর্টের কর্মচারীদের চলছে এমনতর জীবন পরিক্রমা। পৃথিবীর এই উত্তর কোণে মানুষের চেহারা, রঙ, ধর্ম, বর্ণ যেমন ভিন্ন তেমনি ভিন্ন তাদের জীবনযাত্রার রূপরেখা। অনেকক্ষণ হ্রদের কাছে বসে ছিলাম। এই হ্রদের নাম লেক ভের্নন। সুইডেনের সবচেয়ে বড় হ্রদ এটি। শহর থেকে অনেক দূরে দিগন্ত জোড়া সবুজ বনানী বিশাল অরণ্যানীর বেষ্টনে হ্রদের তীরে এয়ার বেসটি গড়ে উঠেছে। অনেকক্ষণ এখানে থেকে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপের ছায়ায় সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
৩০ তারিখ আবার বের হলাম। নিকটবর্তী শহর লিডকপিং। প্রয়োজনীয় ঘরের কিছু কিনতে হলে এখানে আসতে হয়। এবং এখানকার নিয়ম অনুযায়ী সদ্য প্রসূত বাচ্চাকে চেকাপ করাতে হয় এখানে এসে। বুড়ো-বুড়িদের অবসর বিনোদনের জন্য নার্সিং হোমেরও ব্যবস্থা আছে। দেখলাম বৃদ্ধা মহিলাদের কেউ কেউ অবসর বিনোদনে এসে কাঠের ফ্রেমে কাপড় এঁটে ফুল বুনছেন। বেশি বৃদ্ধদের জন্য বাথটবে সিঁড়ি লাগানো আছে। বয়সের কারণে এখানে এসে যারা সুযোগ সুবিধা নিতে পারে না। তাদের সাহায্য করার জন্য ১৬ থেকে ১৭ বছরের কয়েকটি মেয়ে আছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও এসব বৃদ্ধদের খবরদারি করে। নার্সিং হোমের এক মেয়ে আমাকে ঘুরে ঘুরে সব দেখালো। আমি যেনো প্রাণের কিছু স্পর্শ পেলাম এখানে এসে।
আমার জামাতা উলফের গ্রামের বাড়ি সুইডেনের পশ্চিম দক্ষিণ-প্রান্তের একটি ছোট শহর টেলবর্গে। ওর মা-বাবা তাদের নাতিকে দেখার জন্য ৩-৭-১৯৮৭ তে এসে হাজির। আমার বেয়াইন-বেয়াই আসাতে বাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গেলো। গল্প-গুজব আর আড্ডায় দিন কেটে যাচ্ছে। বিকেল হলে নাতিকে নিয়ে ফরেস্ট ঘুরে বেড়াই, ঠিক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। ইউরোপের উত্তর গোলার্ধের শেষ মাথায় ভিন্ন জগতের ভিন্ন বর্ণ ধর্মের মানুষের মধ্যে কয়েকদিন আমার ভালোই কাটে।
৫-৭-১৯৮৭ তে দুই বেয়াইন বেড়াতে গেলাম লিডশপিং এ কিছু কেনাকাটার জন্য। কিন্তু কিছুই পছন্দ হলো না। ফিরে এলাম শুধুমাত্র আইসক্রিম খেয়ে। আমার বেয়াইনের নাম উল্লা আর বেয়াইয়ের নাম ক্রিসট্রোফার। দু’জনেই বেশ মজার মানুষ। বাংলাদেশি দাদা-দাদী, নানা-নানীদের মতোই নাতী-নাতনীদের প্রতি আদর-সোহাগের কমতি নেই। দুই দিন বেশ আনন্দ-উল্লাস করে চলে গেলেন ট্রেলবর্গ। যাওয়ার দিন রুবা তাদের সম্মানে ইন্দোনেশিয়ান ডিস রান্না করে অত্যন্ত পরিপাটি করে পরিবেশন করলো। তারা রুবার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমিও গর্বিত। বাড়িটা তাদের যাওয়াতে আবার শূন্য হয়ে গেলো। ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে বাবা-মা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মন বসছে না কিছুতেই। যে নাতিকে দেখার জন্য ছুটে এসেছি। তাকে কোনো সময় কোলে পাচ্ছি না। সে সবসময় ঘুমায়। যখন জাগে তখন মা-বাবা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে কোলে নিয়ে আদর করার সময় আমার হয় না।
একদিন গথেনবার্গ থেকে রুবার এক সুইডিশ বান্ধবী এলো। নাম পিয়া, স্বামীসহ নতুন বাচ্চাকে দেখতে। সঙ্গে প্রচুর উপহার। তারা দু’তিন দিন থাকলো বাড়ির লনে তাঁবু গেড়ে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এটা নাকি এদেশে নিয়ম। ওরা কারো ঘরের ভেতরের শৃঙ্খলা নষ্ট হতে দেয় না। খাওয়া দাওয়া ঘরে হলেও বাইরে তাঁবুতেই ওদের বসবাস। রুবা আমার মনের বিষণœতার কথা হাসতে হাসতে তার বান্ধবী পিয়াকে বললো, আমার মাকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ নরওয়ে দেখিয়ে আনো। সেখানেতো তোমার নানার বাড়ি। বলা মাত্র সে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। খাওয়ার টেবিলে বসে বলে মা দু-একদিনের মধ্যে নানা বাড়ি যাবে। আন্টিকে তৈরি করে রেখো সঙ্গে নিয়ে যাবো। ভিসা হয়ে গেলো। পরবর্তীতে নরওয়ে যাওয়া হলেও সেবার আর যাওয়া হয়নি।
স্টকহোমের বাঙালিরা প্রায় সবাই তরুণ। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সবার বয়স ছিলো বিশ-বাইশ বছরের মধ্যে। এই সময় নানা কারণে এই সব ছেলে দেশ ছেড়ে জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। কেউ এসেছে পালিয়ে, কেউ এসেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। এদের প্রায় সবাইকে আমি চিনি। প্রায় সবাই আমার কোন না কোন ছেলের বন্ধু। তবে আমার বড় ছেলে রুমির বন্ধুর সংখ্যাই বেশি। দেশ ছাড়ার আগে ওদের চোখে ছিলো সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন, দেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ওরা এখন পরবাসী।
মমতাজের কাছে আমার আসার খবর পেয়ে ওরা সবাই এলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার দেশে ফেরার আগে ওরা আমাকে নিয়ে পিকনিক করলো। শহরের বেশ দূরে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। মুরাদ ও তার বৌ আমাকে গাড়ি করে নিয়ে গেল। মেঘলা আকাশ ঝির ঝির বাতাস উপেক্ষা করে চলছে পিকনিকের আয়োজন। সবাই প্রায় উপস্থিত। ছেলেরা নিয়েছে রান্নার দায়িত্ব। মেয়েদের ওপর ব্যবস্থাপনার ভার। খাবার শেষে খেলাধুলারও ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েদের জন্য স্কিইং, দৌড় ও মিউজিক্যাল চেয়ার। ছেলেদের জন্য সাঁতার, ফুটবল, পা বেঁধে দৌড়। সব মিলে সে কী আনন্দ, উল্লাস।
সারাদিন হইচই, হট্টগোল, আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ফিরে আসার সময় ছেলেদের বৌরা ধরে বসলো ওদের সমিতির পত্রিকার জন্য একটা কবিতা দিতে হবে। ওখানে বাঙালি মেয়েদের একটা সমিতি আছে। এই সমিতির মেয়েরা একটা পত্রিকাও বের করে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে। জানতে পেরে অনেক খুশি হলাম।
মুরাদের সাথে মমতাজের বাসায় ফিরে এসে সে রাতেই একটি কবিতা লিখলাম। জানি না কবিতা হয়েছে কিনা। কবিতার ঢঙে সুইডেনকে ভালোবাসা জানিয়ে আমার ভ্রমণ কাহিনী ইতি টানতে চাই।
সুইডেনের প্রতি ভালোবাসা
রক্ত গোলাপের মতো ফুটে আছে
বুকের অতলে আমার
দামি আতরের সুবাস সুইডেনের স্মৃতিতে।
সুইডেন এক আনন্দ সুন্দর ফুল বাগান।
কর্মনিষ্ঠ, সময়নিষ্ঠ সৎ মানুষের দেশ সুইডেন।
বিপন্ন মানবতার সেবায় নিবেদিত সুন্দর
একটি দেশের নাম সুইডেন।
বিজ্ঞান মানবতার সেবায় নিবেদিত সুন্দর
একটি দেশের নাম সুইডেন।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিক্ষা সভ্যতার শীর্ষে
এই দেশের অবস্থান।
পূর্ব দেশের ললনা আমি।
উত্তর প্রবাসে এসে নিয়ে গেলাম
দেশের মনোহর সুন্দরকে দু’চোখ ভরে
কর্মের প্রেরণা পেলাম হৃদয় জুড়ে।
আল্লাহর সৃষ্ট রাজ্যে অনুপম সুন্দর
একটি দেশের নাম-
সুইডেন! সুইডেন!!
কবিতার শেষে সুইডেন সম্পর্কে তোমাদের জানার জন্য কিছু তথ্য দিয়ে এবার আমার বিদায়ের পালা।
সুইডেন ইউরোপ মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম স্টকহোম। ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। সুয়েডীয় সুইডেনের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বদিকে রয়েছে ফিনল্যান্ড, পশ্চিমে নরওয়ে ও দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ওরেসুন্দ সেতু। যেটা দিয়ে ডেনমার্ক যাওয়া-আসা করা হয়। সুইডেন স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর বৃহত্তম রাষ্ট্র। সুইডেনের আয়তন ৪,৫০,২৯৫ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা মাত্র ৯৫ লক্ষ। সুইডেনের সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী স্টকহোম। ছোট বড় চৌদ্দটি দ্বীপ নিয়ে স্টকহোম। দ্বীপগুলো পরস্পর সেতু দিয়ে সংযুক্ত। স্টকহোম নামকরণে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস আছে। ১৩ শ’ শতকে হেলজেন্সহোলস নামক জায়গায় স্টকহোম শহরের গোড়াপত্তন হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য দু’টি দ্বীপের মাঝে শহরটিকে সরিয়ে আনা হয় বলে এর নামকরণ হয় স্টকহোম। স্টক শব্দের অর্থ-রক্ষিত করা আর হোলম অর্থ দ্বীপ। সুইডেন এ শুধু স্বর্ণকেশীদের বসবাস এই ধারণাদি মিথ্যে। কেননা দেশটির ১৫ (পনেরো) লাখই অন্য দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। সুইডিশরা সমাজতন্ত্রী নয়, সবচেয়ে বেশি করদাতাও নয়। আত্মহত্যায় সুইডিশরা শীর্ষে এটাও সঠিক নয়। সুইডিশকে নিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় দেশ বলা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলারের ন্যাৎসি বাহিনীকে নরওয়ে দখলের জন্য সুইডিশরা পথ দেয়।