গত সংখ্যার পর
‘সেটাই চিন্তা করছি-’ একটু থামলো অয়ন। ‘খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারবো না, তবে চেষ্টা করতে দোষ নেই। অন্তত কোন তথ্য দিয়েও যদি আব্বুকে সাহায্য করতে পারি, তাও মন্দ কী।’
মাহি বললো- ‘আমি ভাবছি অন্য কথা, এসব খুন-খারাবির ঘটনায় খালু কি আমাদের নাক গলাতে দেবে?’
‘এটা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আর আমরা এখনই এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলছি না।’ খাওয়া শেষ করতে করতে বললো অয়ন।
‘ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।’ এক সাথে সম্মতি জানালো মাহি আর ফাহাদ।
বিকেলেই আবার ঘটনাস্থলে রওনা হলো তিনজন। উদ্দেশ্য জায়গাটা একটু ভালোভাবে দেখা। সকালে লোকজনের ভিড়ে সব কিছু দেখা সম্ভব হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিসও চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। কিংবা শ্রমিকদের সাথে কথা বললেও হয়তো কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। রাস্তার কিনারায় এসে অয়ন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো পুরো এলাকাটির দিকে। মনে মনে কিছু পরিকল্পনা করে নিলো। তারপর নামলো রাস্তা থেকে। আজ কোন কাজ হচ্ছে না প্রজেক্টে। শ্রমিকরা সবাই এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। পুরো এলাকাজুড়েই নীরবতা বিরাজ করছে। হাঁটতে হাঁটতে বজলু মিস্ত্রির ঘরের কাছে এলো অয়ন। ঘরের সামনে কয়েকজন লোক বসে আছে চুপচাপ। একজনকে চিনলো অয়ন। সকালে সেই খুনের ঘটনা বলেছে উপস্থিত লোকদের কাছে। লোকটাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে নিজের পরিচয় দিলো অয়ন। অয়নের পরিচয় পেয়ে মতিন হাসলো, বললো- ‘ভাইজান, আপনি এমন সময় আসলেন যখন আমরা মারাত্মক বিপদের মধ্যে। বলেন তো আপনারে কিভাবে খাতির করি।’
‘না না কোন কিছু করতে হবে না। আমি সব জানি, সকালেও এসেছিলাম। এসেছি জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে।’
‘ঠিক আছে দেখেন। কিছু লাগলে আমারে বইলেন, আমার নাম মতিন।’ বললো লোকটি।
‘ঠিক আছে বলে’ বলে হাঁটতে শুরু করলো অয়ন। বজলু মিস্ত্রির ঘরের অন্য পাশে চলে এলো। যেখানে ঘরের বেড়া কেটে খুনি ঘরে ঢুকেছে সেখানে এসে দাঁড়ালো। আশপাশে তাকিয়ে জায়গাটা ভালোভাবে দেখে নিলো। বেড়ার কাছেই মাটিতে কয়েক ফুট জায়গাজুড়ে দূর্বাঘাস থেঁতলে আছে। মাটি শক্ত তাই কোনো পায়ের চিহ্ন নেই। তবে থেঁতলানো ঘাস দেখে বুঝলো কমপক্ষে দুইজন লোক ছিল এখানে, বেশিও হতে পারে। বেড়ার দিকে মনোযোগ দিল অয়ন। ধারালো কাটার দিয়ে দেড় ফুটের মত টিন ওপর থেকে নিচে কাটা হয়েছে। কাটা অংশটা পাশেই পড়ে আছে। সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো অয়ন, কিন্তু কাজে লাগতে পারে এমন কিছুই পেল না।
‘চল তাহলে, এখানকার কাজ শেষ। আমারা খালপাড় ধরে হেঁটে রাস্তায় উঠি।’ বলেই খালের দিকে হাঁটতে শুরু করলো অয়ন। সাথে অন্যরাও।
পশ্চিম দিক থেকে আসা রাস্তাটা যেখানে খালপাড়ে এসে মিশেছে সেখানে এসে কিছু একটা দেখে হঠাৎ থেমে গেল অয়ন। পানির কিনারায় কালো একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো সেটার দিকে। মোটরসাইকেলের স্পিডমিটারের মত দেখতে জিনিসটি।
৪.
একটু স্মৃতি হাতড়াতেই জিনিসটা চিনতে পারলো অয়ন। সাগরের তলদেশে অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহার হয় এই জিনিস।
‘কিন্তু এটা এখানে কেন?’ নিজেকেই প্রশ্ন করলো অয়ন। তবে জবাব পেল না।
‘ওটা কী ভাইয়া?’ অয়নের হাতের কালো জিনিসটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মাহি।
জবাব দিলো না অয়ন। ঝাড়া কয়েকটি সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো জিনিসটার দিকে। ফাহাদও জানতে চাইলো জিনিসটা সম্পর্কে।
‘বলছি, দাঁড়াও।’ বলে আশপাশ মাটিতে চোখ ঘোরালো অয়ন। এক জায়গায় নির্দিষ্ট দূরত্বে ত্রিভুজের তিন বিন্দুর মতো তিনটি গর্ত নরম মাটিতে। ভিডিও ক্যামেরার স্ট্যান্ড রাখার মত মনে হচ্ছে। একটু দূরে ধূসর রঙের এক টুকরো কাগজ দেখে হাতে তুলে নিলো। একটা ম্যাপের ছেঁড়া অংশ, তবে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
‘কী এগুলো ভাইয়া, গুরুত্বপূর্ণ কিছু?’ ফাহাদ প্রশ্ন করলো এবার।
অয়ন বললো- ‘গুরুত্বপূর্ণ কিনা বুঝতে পারছি না, তবে এই জায়গায় এই জিনিসগুলো বেমানান লাগছে।’
‘কেউ মনে হয় ফেলে গেছে।’ মাহি বললো। ‘কী কাজে লাগে এটা?’
‘সমুদ্রের তলদেশে কোন অনুসন্ধানে ব্যবহার হয় এই যন্ত্রটা। কিছুদিন আগে হলিউডের একটা মুভিতে দেখেছি। সাথে অবশ্য আরও যন্ত্রপাতি দরকার।’ বিড় বিড় করে বললো অয়ন।
‘এই দ্বীপে হয়তো সে রকম কোন কাজ চলছে। সেই লোকজনই হয়তো ফেলে গেছে। এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।’ হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো মাহি।
‘রতœদ্বীপে সে রকম কোন সরকারি বা বেসরকারি অনুসন্ধান চলে বলে কখনও শুনিনি। তোমরা একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।’
বলেই মাটিতে পড়ে থাকা একটা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা কুড়িয়ে তাতে মুড়িয়ে নিলো। জিনিসটা মাহির হাতে দিয়ে চললো প্রজেক্ট এরিয়ার দিকে। দূর থেকে ওরা দেখলো মতিনকে ডেকে কথা বলছে অয়ন। ফিরলো প্রায় দশ মিনিট পর।
পরদিন সকালেই চলে এলেন অয়নের আব্বু। বাংলোয় ব্যাগ রেখে অয়নদের সাথে দেখা করে সাথে সাথেই বেরিয়ে গেলেন তিনি। অয়নও আব্বুর সাথে বেশি কথা বললো না। জানে এই মুহূর্তে তার মনের অবস্থা কী। সামনে অনেক ঝামেলা। কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ত কাটবে তার। ওরাও বাড়ি থেকে বের হলো না আর। ভাবলো দ্বীপের ঘটনাগুলো নিয়ে। ছিনতাই, ডাকাতি সবশেষে খুন। এসব কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি একটার সাথে আরেকটা জড়িত। খুনের ঘটনার সাথে যদি ওর আব্বুর কোনো শত্র“ জড়িত থাকে বিষয়টি ব্যবসায়িক ধরে নেয়া যায়। কিন্তু দ্বীপের অন্য ঘটনাগুলোর ব্যাখা কী তাহলে। তা ছাড়া ব্যবসায়িক কোনো শত্র“ ক্ষতি করার জন্য এতদূর আসবে কেন? ঢাকাতেও করতে পারতো। কিংবা কাজের কোন ক্ষতি না করে নিরীহ মিস্ত্রিকে খুন করবে কেন? দ্বীপেই বা আসবে কেন ক্ষতি করতে? তাহলে কি শত্র“তা দ্বীপবিষয়ক? তাহলে বলতে হবে ঘটনাটা পুরোপুরি ব্যবসায়িক নয়। এর মধ্যে অন্য কোন বিষয় জড়িত আছে। তবে ব্যবসাটা যদি দ্বীপ সংক্রান্ত হয় তাহলে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ধরা যায়। ঘুরে ফিরে দ্বীপের কথাই আসছে বারবার। ঠিক তখনই আলোর ঝলকের মত বিষয়টা মনে এলো মাথায়। দ্বীপের শত্র“!
‘ইয়েস!’ হাতে তুড়ি বাজালো অয়ন।
‘কি হলো ভাইয়া?’ পাশের বেড থেকে একত্রে উঠে বসলো ফাহাদ আর মাহি। চুপচাপ শুয়ে ছিল দু’জন এতক্ষণ।
‘আচ্ছা রতœদ্বীপের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলোকে যদি আমরা পাশাপাশি সাজাই তাহলে কি পাওয়া যায়?’ দু’জনের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো।
‘সব ঘটনা তো আর এক সারিতে সাজাতে পারবে না। যেমন ধর খুনের ঘটনা।’ বিজ্ঞের মত বলতে শুরু করলো ফাহাদ। ‘ছিনতাই, ডাকাতি এগুলো ধরে নেয়া যায় অর্থের লোভে করেছে, কিন্তু বজলু মিস্ত্রির খুনটা তো এর সাথে যায় না।’
মাহি বললো- ‘ফাহাদ ঠিকই বলেছে ভাইয়া। বজলু মিস্ত্রির খুন যে টাকা-পয়সার জন্য হয়নি এটা তো একরকম নিশ্চিত।’
‘কিন্তু লোভটা যদি অন্য কিছুর হয়? মানে টাকা পয়সা ছাড়া এমন কিছু যেটার সাথে এগুলো সবই জড়িত।’ বললো অয়ন।
‘কি সেই বিষয়?’ একসাথে জানতে চাইলো দুই কিশোর।
‘ধর, কেউ যদি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটায়। প্রথমে ছিনতাই তারপর ডাকাতি এরপর খুন। সামনে হয়তো আরও বড় কিছু…’
‘কে হতে পারে সে?’ এবার বুঝতে পারলো ফাহাদ।
মাহি বললো- ‘তাতে তার লাভটাই বা কী?’
‘এমন কেউ হতে পারে যে টাকা পয়সা নয়, অন্য কিছু চায়। এবং সেটা বড় কিছু।’ ওদের ধাঁধায় ফেলে যেন মজা পাচ্ছে অয়ন।
‘উফ ভাইয়া তাড়াতাড়ি খুলে বলো না। এভাবে রহস্য করার কোন মানে হয় না।’ বললো মাহি।
‘সে এমন কেউ, যে চায় না দ্বীপের সৌন্দর্য বাড়–ক, পর্যটন স্পট হিসেবে এটা জনপ্রিয় হোক। মানে অন্য কিছু নয়, পুরো রতœদ্বীপটাই তার টার্গেট।’
‘তাতে তার লাভ?’ একই প্রশ্ন আবার করলো মাহি।
‘বুঝতে পেরেছি।’ লাফিয়ে উঠলো ফাহাদ। ‘রতœদ্বীপের দখল নিতে চায় লোকটা। তাই না অয়ন ভাইয়া?’
‘ঘটনা দেখে তাই মনে হচ্ছে। সত্য মিথ্যা জানি না, এসবই আমার অনুমান।’ অয়ন বললো।
‘তুমি যখন ধারণা করেছ, একেবারে মিথ্যা হতে পারে না। কিন্তু তাতে এত কিছুর কী দরকার।’ মাহি বললো।
‘আগের অনুমানটা সত্যি হলে এটাতো আরও সহজ হিসাব। দ্বীপের বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মনে ভয় ধরাতে পারলে এখানে লোক আসা বন্ধ হবে, বাসিন্দারা ভয় পেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে। একই কথা খুনের ব্যাপারেও, মিস্ত্রিরা প্রাণের ভয়ে পালাতে বাধ্য হলে বন্ধ হবে পর্যটন স্পটের কাজ।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো অয়ন।
‘এতো দেখছি বিশাল ষড়যন্ত্র!’ বললো মাহি। ‘এটা ঠেকানোর জন্য কিছু করা যায় না।’
‘কে হতে পারে সেই লোক, ভাইয়া?’ ফাহাদ জানতে চাইলো। ‘কেনই বা দ্বীপটা দখল করতে চায়?’
‘তোমাদের তো আগেই বলেছি এটা আমার অনুমান। তবে আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে যে বা যারা এটা করতে চায় অনেক শক্তিশালীই হবে। এতবড় একটা কাজ যার-তার দ্বারা সম্ভব নয়।’
‘আমরা কি এটা নিয়ে কিছু করতে পারি না? যাতে দ্বীপটার উপকার হয়। মানে বলছিলাম… শত্র“কে ধরিয়ে দিতে পারলে দ্বীপটা বাঁচতে পারে।’ বললো ফাহাদ।
‘ফাহাদ ঠিকই বলেছে ভাইয়া, আমরা তো এই কেসটার বিষয়ে তদন্ত করতে পারি।’ সায় দিল মাহি।
‘গভীর সমুদ্রে জাহাজ থেকে খালি হাতে ঝাঁপ দেয়া আর এই কেসের তদন্তে নামা প্রায় সমান কথা। কোন সূত্র নেই, অচেনা-অজানা জায়গা। এমনকি সাহায্য করার মত কোন লোকও নেই। বড় কঠিন কাজ। তবে এটাও ঠিক রহস্য এমন এক জিনিস যে অনেক বড় সমস্যার সমাধানও অনেক সময় হাতের কাছে পাওয়া যায়। কখনও কখনও না চাইতেই হাতে এসে ধরা দেয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো কোন কিছুই অসম্ভব নয়।’ বিশেষজ্ঞের মতো ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বললো অয়ন।
ওর শেষের কথাগুলো শুনে মাহি আর ফাহাদ কিছুটা আশান্বিত হলো।
শুরু থেকে এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আবার সাজাতে শুরু করলো অয়ন মনে মনে। দ্বীপে আসার পথেই ট্রলারে শুনেছে দ্বীপের ছিনতাই ডাকাতির কথা। এটা কি ইচ্ছাকৃত নাকি লোক মুখের স্বাভাবিক কথা। ইচ্ছাকৃত হলে ধরে নেয়া যায় দ্বীপে আসার পথেই কৌশলে পর্যটকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেদিন দ্বীপে এলো সে রাতেই ডাকাতি হলো গবেষকের বাড়িতে। পরদিনই খুন। হঠাৎ সেই লোকটার মুখটা মনে পড়লো অয়নের। গবেষক ভদ্রলোকের সাথে থাকে সে, নাম লাভলু। হ্যাঁ লাভলুই সেদিন ট্রলারে বসে চারজন ছাত্রের সেই দলটার কাছে বলেছে দ্বীপের খারাপ পরিস্থিতির কথা। কি আশ্চর্য সেদিন রাতেই লাভলুদের বাড়িতে ডাকাতি হলো। ডাকাতির পর লাভলুকে দেখে অয়ন এটাই মনে করতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু কিছুতেই মনে আসেনি। আবার ডাকাতির ঘটনাটাও কিছুটা রহস্যময়। পরদিন সকালে ওরা খালের পাড়ে গিয়ে দেখেছে যেখানে স্পিডবোট থেমেছে সেই কাদামাটিতে মাত্র একজোড়া পায়ের ছাপ; কিন্তু বাড়ির লোক বলেছে ডাকাত ছিল চার-পাঁচ জন। এতগুলো লোক একসাথে স্পিডবোটে ওঠানামা করলে কাদা মাটিতে তাদের পায়ের ছাপ না থেকে পারে না। তাহলে কি এটা সাজানো নাটক! কোন রহস্য আছে এখানে! ভেবে পেল না অয়ন।
৫.
‘কিভাবে শুরু করতে চাও ভাইয়া?’ অয়নের চিন্তায় ছেদ পড়লো ফাহাদের প্রশ্নে।
অয়ন চিন্তায় ডুবে ছিল এতক্ষণ। মাথা তুলে তাকালো ওদের দু’জনের দিকে।
‘কিভাবে শুরু করতে চাও বলো, আমরা কিন্তু রাজি।’ মাহির গলায় উত্তেজনা।
‘ঘটনা যেখান থেকে শুরু আমাদেরকেও সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। মানে গবেষকের বাড়ি। আমরা আসার পর ঐ বাড়িতেই প্রথম ঘটনাটা ঘটেছে। তাই আমাদের প্রথম কাজ সেখানেই।’ অয়ন বললো।
ফাহাদ জানতে চাইলো ‘কী খুঁজবো সেখানে আমরা?’
অয়ন বললো- তোমাদের তো বলা হয়নি, সেদিন খালপাড়ে ঐ যন্ত্র আর ম্যাপের টুকরো পাওয়ার পর আমি মতিনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম।
মাহি বললো, ‘মনে পড়েছে, আমাদের রেখে ফিরে গিয়েছিলে মতিনের সাথে কথা বলতে, তাই না!’
‘হুম।’ মাথা দোলায় অয়ন। ‘মতিনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম দ্বীপে কোন জরিপের কাজ চলে কি না, সে বলেছে আমাদের সামনের বাড়িতে যে গবেষক থাকে তাকে নাকি কয়েকদিন দেখেছে দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় কি সব মেশিনপত্র আর ম্যাপ নিয়ে কাজ করতে। তাছাড়া খুনের আগের দিন বিকেলে নাকি লাভলুকে দেখা গেছে প্রজেক্ট এলাকায় ঘুরতে। আরেকটা কথা, সেদিন দ্বীপে আসার সময় ছাত্রদের কাছে দ্বীপ সম্পর্কে ভয়ভীতি দেখানো লোকটিও ছিল ঐ লাভলু। এই তিনটি পয়েন্টের মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে, আর যদি থেকেই থাকে তাহলে গবেষক আর তার সহকারীকে সন্দেহ করতেই হবে। তা ছাড়া আমাদের হাতে যেহেতু আর কোন বিকল্প নেই, তাই এটা দিয়েই আমরা চেষ্টা করবো। কাজেই আমাদের প্রথম টার্গেট হবে ঐ বাড়ি কিংবা ওখানকার লোকগুলো।
‘কখন শুরু করবো ভাইয়া বলো না।’ মাহি উত্তেজিত হয়ে বললো। ‘আমার আর দেরি সইছে না।’
‘কালকে সকালে। আজ আমরা আরও কিছু বিষয় নিয়ে ভাববো। কাল সকালেই শুরু হবে মূল কাজ। তবে মনে রাখবে, উত্তেজিত হয়ে কিছু করা যাবে না। এসব কাজে উত্তেজনা অনেক সময় বিপদের কারণ হয়।’ সাবধান করে দিল অয়ন।
‘তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই আমরা চলবো। তুমিই তো আমাদের দলনেতা।’ ফাহাদ বললো।
মাহি আবার বললো- ‘তাহলে আগামীকাল থেকেই আমার শুরু করছি আমাদের তদন্ত। তুমি দেখে নিও অয়ন ভাইয়া যে কোন মূল্যে আমরা এই রতœদ্বীপের রহস্য উন্মোচন করবোই।’
পরদিন সকালে সালাম মিয়ার তৈরি নাশতা খেয়ে বের হলো ওরা। বাড়িটার নাম দ্বীপ নিবাস আগেই দেখেছে অয়ন। রাস্তার পাশে পশ্চিমমুখী বাড়িটার চতুর্দিকে দেয়াল থাকলেও প্রবেশমুখটা খোলা। গেট লাগানো হয়নি এখনও। রাস্তা থেকে আট দশ পা হেঁটে ঘরের দজায় এসে দাঁড়ালো তিনজন। ভারী কাঠের দরজায় আঙুল দিয়ে টোকা দিল অয়ন। আধা মিনিট পার হয়ে গেলেও কেউ খুললো না। কি মনে করে দরজায় চাপ দিল এবার। আস্তে সরে গেল দরজা। গলা বাড়িয়ে ডানে বামে তাকালো অয়ন। সামনের বারান্দায় কেউ নেই। ভেতরে কেউ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। বারান্দাটা পার হয়ে ভেতরের রুমে ঢুকে পড়লো অয়ন। ওর পেছনে মাহি আর ফাহাদও ঢুকেছে। ভেতরের ঘরের ডান পাশের একটি টেবিল ঘিরে তিনজন লোক বসে আছে। টেবিলে একটি ম্যাপ বিছিয়ে সামনে বসা দু’জনকে কিছু একটা দেখাচ্ছেন গবেষক। ছোট একটা যন্ত্রও রাখা আছে টেবিলে। অয়নকে ঢুকতে দেখেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একসাথে সবাই। তিনজনই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অয়ন বুঝলো এই সময় ওর আসাটা তাদের কাছে শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তারা ভয় পেয়েছে। গবেষক ভদ্রলোক উঠে ওদের সামনে এলেন, অন্য আরেকজন টেবিলে বিছানো ম্যাপটি দ্রুত ভাঁজ করে ফেললো।
‘এই ছেলেরা তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছো? ততক্ষণে ইতস্তত ভাব কেটে গিয়ে রাগি ভাব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়।
ধমক শুনে কথা হারিয়ে ফেললো অয়ন, ‘জি মানে.. .. আমরা সামনের বাংলোয় থাকি।’
‘সামনের বাংলোয় থাকো তো এখানে কী? ঘরে ঢুকলে কি করে তোমরা? লাভলু.. . লাভলু কোথায় গেলে?’ শেষ কথাগুলো তার সহকারীর উদ্দেশে।
ব্যস্ত হয়ে পেছনের রুম থেকে দৌড়ে এলো লাভলু। ‘জি স্যার বলেন.. আমিতো চা করছিলাম।’
‘এরা কারা? ঘরের ভেতর ঢুকলো কি করে? তোমাকে কতবার বলেছি না আমাকে জিজ্ঞেস না করে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।’
‘কি ব্যাপার তোমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকলা ক্যান না জিজ্ঞেস করে!’ ধমক খেয়ে সেটার শোধ ওদের ওপর যেন নিতে চাইলো লাভলু।
‘আসলে লাভলু ভাই,… আমরা এসেছিলাম গবেষক আঙ্কেলের সাথে পরিচিত হতে। দরজা খোলাই ছিল, সামনের রুমে কাউকে না পেয়ে ভাবলাম আপনারা হয়তো ভেতরেই আছেন। তাই ঢুকে পড়লাম।’ আগে থেকে সাজিয়ে রাখা কথাগুলো এবার ছাড়লো অয়ন।
‘আমার কাছে কি কাজ তোমাদের?’ গবেষক চড়া গলায় জানতে চাইলো।
‘কিছু না আঙ্কেল এমনিই এসেছিলাম, আপনারা মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন। ঠিক আছে চলি।’ বলেই সঙ্গীদের ইশারা করে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো অয়ন। দরজার কাছে চলে এসেছে এমন সময় আবার পেছন থেকে গবেষকের গলা শুনলো
‘এই ছেলেরা! বসো, তোমাদের সাথে কথা আছে।’ ইশারায় সামনের বারান্দার চেয়ার দেখিয়ে দিলেন।
সামনের বারান্দায় খাটের পাশে একটা কাঠের টেবিল আর দুটো চেয়ার। অয়নরা তিনজন পাশাপাশি খাটে বসলো। পাঁচ মিনিট পর এলো লোকটি। একটি কাঠের চেয়ার টেনে বসে অয়নের চোখে চোখ রেখে বললো- ‘আমাকে কেন খুঁজছো তোমরা? কে পাঠিয়েছে তোমাদের?’
ভদ্রলোক ওদের আসাটাকে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে বুঝলো অয়ন। তবে সেটা প্রকাশ না করে বললো- ‘কেউ পাঠায়নি, আমরা সামনের বাড়িতে উঠেছি। যেহেতু পাশাপাশি থাকি তাই পরিচিত হতে এসেছিলাম।’
‘আমার সম্পর্কে কার কাছে শুনেছো তোমরা?’
‘দ্বীপের লোকজন বললো আপনি নাকি সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করেন। ওর আবার সমুদ্র নিয়ে অনেক কৌতূহল।’ ইশারায় ফাহাদকে দেখালো। ‘ভেবেছিল আপনার কাছে হয়তো অনেক তথ্য জানতে পারবে, কিন্তু আমরা এসে আপনাদের এভাবে সমস্যায় ফেলবো বুঝতে পারিনি, স্যরি আঙ্কেল।’
জবাব পেয়ে মনে হলো কিছুটা সন্তুষ্ট হলো বুড়ো। চেহারার কঠিন ভাবটা দূর হয়েছে। তবে ওদেরকে এতটা সিরিয়াসভাবে নেয়ার পেছনে কোন কারণ আছে বলেই সন্দেহ হলো অয়নের।
‘তারপর কী জানতে চাও বলো?’ সহজ হয়ে এলো বুড়োর গলা।
‘আঙ্কেল, আপনি কি সরকারি গবেষণা করছেন নাকি ব্যক্তিগত?’ অয়নই আবার প্রশ্ন করলো।
কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলো বুড়ো তারপর বললো- ‘আমি বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক। প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করছি এখানে।’
এরপর সমুদ্রবিষয়ক দু-একটি প্রশ্ন করে বেরিয়ে এল ওরা। গবেষকের নামটাও জেনে নিলো প্রশ্ন করে। লাভলু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা রাস্তায় না ওঠা পর্যন্ত।
‘বাপরে এত্ত মেজাজ! ব্যাটারা কি ভেবেছে আমরা ওদের চুরি করতে গেছি?‘ রাস্তায় উঠে প্রথম কথা বললো ফাহাদ।
মাহি বললো- ‘পরে কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে আমাদের ভালো খাতিরই করেছেন। ভদ্রলোকের নাম ড. শাহেদ তাই না?’
‘ওটা খাতির নয় মাহি।’ বললো অয়ন। ‘আলাপ করে উনি নিশ্চিত হতে চেয়েছেন আমরা কেন গিয়েছি তার বাড়িতে? নিছকই কৌতূহল নাকি অন্য কিছু।’
‘এটা অবশ্য আমারও মাথায় আসেনি, অয়ন ভাইয়া।’ বললো মাহি। ‘আমরা কি সন্দেহ করার মত কিছু করেছি!’
‘আমরা সন্দেহ করার মত কিছু করিনি, তবে চোরের মন পুলিশ পুলিশ বলে একটা প্রবাদ আছে না! তা ছাড়া ওনার ঘরে দুইজন নতুন লোক ছিল তখন। আমরা ঘরে ঢোকার সময় ওনারা কোন জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের দেখেই তাই ভয় ও রাগ দুটোই হয়েছে তাদের। অচেনা ঐ লোক দুটোর সাথে ম্যাপ নিয়ে কি সব আলাপ করছিল বুড়ো, এই ব্যাপারটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আর পরের বৈঠকটা ছিল মূলত আমাদেরকে যাচাই করে দেখা। আমার মনে হয় আমরা তাকে সন্দেহ করছি এই ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারেননি। আমরা বরং ওনার পরিচয়টা জেনে আসতে পেরেছি।’
‘ঐ লোক দুটো কারা, ম্যাপ নিয়ে কি করছিল তখন?’ অয়নের কথা শেষে মাহি জানতে চাইলো। ‘আর ওনার পরিচয় জেনেই বা কি করতে পারবো।’
কয়েক মুহূর্তে চুপ করে থাকলো অয়ন। তারপর বললো- ‘জানি না কারা ছিল ঐ বাসায়, কিইবা করছিল তারা। তবে বুড়োর পরিচয়টা নিয়ে কিছু একটা করার আছে। বিকেলেই দেখতে পাবে।’
‘কী করবে বিকেলে ভাইয়া!’ ফাহাদের চোখে রোমাঞ্চের ছোঁয়া।
‘বিকেলে কুয়াকাটা যাবো আমি। এখানে তো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তোমরা বোধ হয় জানো আমার আবীর মামা একটা জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক। তাকে বলবো সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিতে, গবেষকের বিষয়ে যদি কিছু জানা যায়। তার কাজকর্ম কেন যেন সরকারি গবেষণার সাথে ঠিক মিলছে না, কেমন একটা লুকোছাপা ভাব রয়েছে।’
‘ঠিকই বলেছো ভাইয়া, ঐ ব্যাটাকে কেন যেন দুষ্ট লোক বলে মনে হচ্ছে। দ্বীপে যা কিছু ঘটছে তাতে ওর হাত থাকলেও থাকতে পারে। আবার ওর সহকারী লাভলুটাকে দেখেছো, কেমন গুন্ডা গুন্ডা চেহারা! গবেষকের সহকারীর এমন চেহারা হয় কি করে। তুমি মামাকে ভালো করে ওর অফিসে খোঁজ নিতে বলো।’ এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মাহি। ততক্ষণে নিজেদের বাংলোয় ঢুকে পড়েছে ওরা।
বিকেলেই সালাম মিয়ার সাথে কুয়াকাটা গেল অয়ন। কাজ শেষে আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলো। সন্ধ্যাটা বাংলোয় কাটালো। দ্বীপে আসার পর কয়েকটা দিন আরামে কাটাতে পারেনি, বেড়ানোও হয়নি। অয়ন প্ল্যান করলো পরদিন স্পিডবোট নিয়ে ঘুরবে দ্বীপের চারপাশে। ওদের নিজেদেরই একটা স্পিডবোট আছে। সালাম মিয়া বলেছে সকালে ড্রাইভারকে ডেকে দেবে।
৬.
পরদিন সকালের নাশতা সেরেই বেরিয়ে পড়লো তিনজন। ওদেরকে খালের ওপর ব্রিজের কাছে দাঁড়াতে বলে সালাম প্রজেক্ট এলাকায় গেছে। গিয়ে ড্রাইভারসহ বোট পাঠিয়ে দেবে। কয়েক মিনিট পর স্পিডবোট এসে ওদের তুলে নিলো। ড্রাইভার ১৯-২০ বছরের একটি ছেলে, নাম মিলন। তিনজনই সাঁতার জানে তবুও মিলনের অনুরোধে লাইফ জ্যাকেট পরে নিলো। খাল ধরে সোজা দ্বীপের উত্তর প্রান্ত দিয়ে সমুদ্রে বেরিয়ে এলো বোট। সমুদ্রে পড়েই ছোট একটা ঢেউয়ের চূড়ায় উঠে গেল বোট। তবে ড্রাইভার দক্ষ হাতে সামলে নিয়ে ওদের আশ্বাস দিল এই মৌসুমে সমুদ্র শান্তই থাকে, খুব বেশি ঢেউ হবে না। দ্বীপের পূর্ব পাশ ঘেঁষে ধীরগতিতে দক্ষিণ দিকে বোট চালাতে বললো অয়ন। ওর ইচ্ছে পুরো দ্বীপটার চারপাশ চক্কর দেয়া। সমুদ্র আর দ্বীপ দুটোই দেখা হবে তাতে। মিনিট দশেক চলার পর দ্বীপের পূর্ব পাশে চলে এলো বোট। এ সময় সমুদ্রের বুকে কিছু একটা দেখিয়ে অন্য দু’জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মাহি। হুট করে কালো মতো কিছু একটা ভেসে উঠেছে পানির উপরে। ওদের বোট থেকে অনেকটা সামনে আর দ্বীপের উপকূল থেকে তিন-চার শ’ গজের মতো সমুদ্রের ভেতরে। নড়াচড়া দেখে অয়ন চিনতে পারলো আকৃতিটাকে। বললো, শৌখিন ড্রাইভার মনে হচ্ছে, হয়তো দ্বীপে বেড়াতে এসেছে।
ড্রাইভার লিটন বললো, ‘সাঁতরাতে কেউ এই এলাকায় আহে না, উনি মনে হয় ভুলে আইসা পড়ছে। ফিরতে সমস্যা হইবো।’
এ সময় ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনে সামনে তাকালো সবাই। দেখলো তীরের গোলপাতার বন থেকে একটি স্পিডবোট বের হয়েছে। ওদের সামনে দিয়ে শোঁ করে বেরিয়ে গেল বোটটি। ঐ বোটের ড্রাইভারের সাথে এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হল অয়নের। দূর থেকে দেখেও চিনতে পারলো লোকটিকে। সোজা ড্রাইভারের কাছাকাছি গিয়ে স্পিড কমলো বোটটির। থেমে লোকটিকে তুলে নিলো বোটে। তারপর নাক ঘুরিয়ে অয়নরা যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিকে চলে গেল।
ফাহাদ ড্রাইভারকে বললো- ‘দেখেছো মিলন ভাই, ড্রাইভার ভুল করে আসেনি, তাকে তুলে নেয়ার জন্য লোক আগে থেকেই রেডি আছে। অনেক প্রস্তুতি নিয়েই দ্বীপে বেড়াতে এসেছে।’
‘আমার আফসোস হচ্ছে, এরকম একটি জায়গায় বেড়াতে আসবো জানলে আগেই ড্রাইভিং শিখতাম। সমুদ্রে যদি সাঁতরাতেই না পারলাম তবে কি আর আনন্দ পূর্ণ হয়।’ বললো মাহি।
ওদের কথায় কান নেই অয়নের। ওর মাথায় তখন অন্য চিন্তা। স্পিডবোটকে দেখার পর থেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছে সে। বিষয়টা স্বাভাবিক হতে পারে। তবও কেন যেন মনের মধ্যে খুঁতখুঁতে ভাবটা রয়ে যাচ্ছে।
‘আচ্ছা মিলন ভাই, স্পিডবোটটাকে তো আগে দেখিনি, হঠ্যাৎ কোথা থেকে এলো ওটা।’ ড্রাইভারকে প্রশ্ন করলো।
‘মনে হয় ড্রাইভার গোলপাতার মধ্যে বোট ঢুকাইয়া বইসা আছিল। ঝোপের মধ্যে থেইকাইতো বাইরাইলো। ঐ লোকটা যতক্ষণ সাঁতার কাটছে ড্রাইভার আরামে ঘুমাইছে।’ বললো মিলন।
আর কিছু বললো না অয়ন, সমুদ্র দেখায় মন দিলো। বোট এগিয়ে চললো দক্ষিণ দিকে। গোলপাতার বন শেষ হয়ে গেল একটু পরই। সামনে জেলে নৌকার একটি ঘাট। অনেক জেলে নৌকা বাঁধা ঘাটে। কোন কোন নৌকায় মাঝিরা জাল মেরামতের কাজ করছে। জেলে নৌকার ঘাটের পর ট্রলার ঘাট। কুয়াকাটা যাতায়াতের ট্রলারগুলো এই ঘাটেই ভিড়ে। ট্রলার ঘাটের দক্ষিণ দিকে খোলা বিচ। মূলত এই জায়গাটাকেই টুরিস্টরা সমুদ্র¯œানের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে। বিচের কাছাকাছি আসতেই লোকজনের বিরাট একটা জটলা চোখে পড়লো। দুটো ট্রলার ভিড়ানো আছে বিচ ঘেঁষে। লোকজনের হইচই দেখে ড্রাইভার মিলন বোটের ইঞ্জিনবন্ধ করে দিলো। ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো- চলেন তো দেহি কি হইছে, এত গ্যাঞ্জাম কিসের?
বোট থামিয়ে লাফিয়ে নামলো মিলন সবার আগে। পেছনে ওরাও নেমে পড়লো। জটলার কাছে এসে দেখলো একটি লোক শুয়ে আছে বালুতে। বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ হবে। পরনে শর্টস গায়ে টি-শার্টের ওপর লাইফ জ্যাকেট। পাশে কয়েকজন কান্না করছে তাকে ঘিরে। উপস্থিত লোকেরা নানা রকম কথা বলছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে ঘটনা জেনে নিলো ওরা। বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছে লোকটি। কয়েক মিনিট আগে সমুদ্রের পানিতে গোসল করতে নেমে হঠাৎ তলিয়ে যায়। উপস্থিত সবার কাছে আশ্চর্য লাগছে বিষয়টা। লোকটির সঙ্গীরা বলছে সে সাঁতার জানে, তার ওপর লাইফ জ্যাকেটও ছিল গায়ে। সমুদ্র ছিল শান্ত। এমন পরিস্থিতিতে একটি লোক কিভাবে তলিয়ে গেল তা কেউ বুঝতে পারছে না। গলা পানির চেয়ে একটু দূরে সাঁতার কাটছিল লোকটি। তলিয়ে যাওয়ার আগে হাত তুলে আ…আ… বলে দুইবার চিৎকার দিয়েছে। তারপর আর দেখা যায়নি লোকটিকে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তীর থেকে দূরে ভেসে ওঠে শরীর। তার সঙ্গীদের চিৎকারে ঘাট থেকে দুটো ট্রলার এগিয়ে এসে উদ্ধার করে লোকটিকে। কিন্তু ততক্ষণে দেহ থেকে বেরিয়ে গেছে প্রাণ। নানাজন নানা কথা বলছে। তার মধ্যে ‘কি শুরু হইলো দ্বীপে’ টাইপের কথাই বেশি। কুয়াকাটা পুলিশকে খবর পাঠানো হয়েছে। অয়নদের বেড়ানো হলো না আর। ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে বাংলোয় চলে এলো ওরা।
টুরিস্ট নিহত হওয়ার ঘটনার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়লো রতœদ্বীপে। এত দিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো নিয়ে মানুষের মনে জমে থাকা অবস্থার প্রতিক্রিয়া একদিনেই যেন প্রকাশ হয়ে পড়লো। টুরিস্টরা সবাই যেন বেড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় অধিবাসীরাও যে বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত তা তাদের হাবভাবে ফুটে উঠছে। পুরো দ্বীপজুড়েই একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে শুরু করেছে। পুলিশ এসে নিহতের লাশ নিয়ে গেছে। সাথে তার সঙ্গীরাও চলে গেছে। হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে দেয়া হবে।
সেদিন বিকেলেই আবার কুয়াকাটা গেল অয়ন, সাথে মাহি আর ফাহাদও গেল। অয়নের আবীর মামার কাছে ফোন করলো একটি দোকান থেকে। প্রায় দশ মিনিট কথা বললো অয়ন। মামা জানিয়েছেন সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটে ড. শাহেদ নামে কোন বিজ্ঞানী বা গবেষক নেই। এই অঞ্চলে সমুদ্র নিয়ে ওরকম কোন গবেষণাও চলছে না বর্তমানে। পানি, পরিবেশ কিংবা খনিজসম্পদ নিয়ে কাজ করে এরকম আরও দু’একটি প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়েছেন তিনি। ফলাফল একই।
অয়ন বলেছে- ‘কিন্তু এখানে এমন একজন লোক আছে, তিনি গবেষণাও করছেন বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে সে কে হতে পারে।’
অয়নের কথার জবাবে ওর মামা বলেছেন, ‘হয়তো বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন তিনি, অথবা তুই নাম পরিচয় ভুল জেনেছিস।’
মামাকে আর বেশি কিছু বললো না অয়ন। যা বোঝার বুঝে গেছে ও। গবেষক ড. শাহেদ আসলে ভুয়া নাম পরিচয় নিয়ে দ্বীপে আছে। অথবা গোপন কোন কাজ করছেন যার কারণে সঠিক নাম-পরিচয় দেয়নি ওদের। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে লোকটার।
ফেরার সময় ট্রলারের ছাদে বসে সঙ্গীদের সব খুলে বললো অয়ন। বললো আগের দিনের সেই ড্রাইভার আর স্পিডবোটের চালকের কথাও। সেটা লাভলু ছিল ওরা ভাবতেও পারেনি। সব শুনে ওদের চক্ষু চড়কগাছ। অনেকভাবে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলো তিনজন। দ্বীপে সব ঘটনার লেজ ঘুরে ফিরে ঐ বাড়িটাতেই এসে থামছে। নিশ্চয়ই ও বাড়ির লোকদের হাত আছে এর পেছনে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলো ওরা, যে করেই হোক এ রহস্য উন্মোচন করবেই। খুঁজে বের করবে দ্বীপে এত কিছু কারা ঘটাচ্ছে? কে এই গবেষকরূপী ড. শাহেদ, কি তার উদ্দেশ্য, আর কারা আছে তার সাথে? দ্বীপের ঘটনাগুলোর সাথে তার কি আসলেই কোন সংযোগ আছে নাকি শুধুই সন্দেহ!
(আগামি সংখ্যায় সমাপ্য)