জয়নুল আবেদীন আজাদ
প্রতিভাবান তরুণটি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। কাপড়ে কাদাও লেগেছিল। এ অবস্থাতেই কলেজের ক্লাসে হাজির হলো সে। তবে বসে একেবারে পেছনের বেঞ্চে। তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী। এ দিকে তরুণটি ব্যস্ত অন্য কাজে। সবার অলক্ষ্যে সে কবিতা লিখতে শুরু করে খাতায়। হঠাৎ শিক্ষকের দৃষ্টি যায় সেদিকে। তরুণটি তখন খাতাটি লুকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ধরা পড়ে যায় কবি। খাতায় লেখা কয়েকটি সনেট পড়ে মুগ্ধ হন শিক্ষক। টিচার্স কমনরুমে অধ্যাপকদের সামনে কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনান তিনি। অভিভূত কণ্ঠে অধ্যাপক বিশী বলেন, একজন তরুণ শেকসপীয়রকে আমি আবিষ্কার করেছি।
বন্ধুরা, এই তরুণ শেকসপীয়রই হলেন আমাদের প্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। সে দিন বুদ্ধদেব বসু অধ্যাপক বিশীর কাছ থেকে কবিতার খাতাটি চেয়ে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা তাঁর বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বুদ্ধদেব বসু প্রমথনাথ বিশী, বিষ্ণুদের মত সাহিত্যিকরা ছিলেন ফররুখ আহমদের কলেজজীবনের শিক্ষক। মেধাবী ছাত্র ও প্রতিভাবান কবি হিসেবে ফররুখ ছিলেন এঁদের প্রিয়পাত্র। অনেকেই তখন তাঁকে ‘দ্বিতীয় আশুতোষ’ উপাধিতে ডাকতেন। সত্যজিৎ রায়, ফতেহ লোহানীদের মতো ব্যক্তিত্বরা ছিলেন ফররুখের কলেজজীবনের বন্ধু।
কলকাতায় লেখাপড়া করলেও ফররুখ আহমদ ছিলেন যশোরের মাঝআইল গ্রামের সন্তান। ১৯১৮ সালের ১০ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ হাতেম আলী, মায়ের নাম রওশন আখতার জাহান। কবির পিতা ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। সৎ মানুষ হিসেবে তাঁর ছিলো বেশ সুনাম। পিতার মৃত্যুর পর কিশোর ফররুখ আহমদ ১৯২৭ সালে কলকাতায় বড় ভাইয়ের কাছে চলে যান। সেখানে তালতলা মডেল স্কুল এবং বালিগঞ্জ হাইস্কুলে কিছুকাল লেখাপড়া করেন। পরে ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সেন্ট পল কলেজে প্রথমে দর্শনে ও পরে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে লেখাপড়া করেন। কিন্তু এ সময় বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় কবির আর অনার্স পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
ছোট্ট বন্ধুরা, অনার্স পরীক্ষা না দিলেও জীবনের পরীক্ষা ঠিকভাবেই দিয়েছেন কবি ফররুখ আহমদ। প্রচুর লেখাপড়া করতেন তিনি। তাঁর সাহিত্য পড়লে বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছিলেনÑ সমাজতন্ত্রে নয়, ইসলামেই রয়েছে মানুষের প্রকৃত মুক্তি। তাঁর পরিণত বয়সের লেখালেখিতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যায়। এ কবিতার শেষের পঙ্ক্তিটি হলোÑ
“তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথশেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো,
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো।”
কবি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হেরার তোরণে পৌঁছার সংগ্রাম করে গেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, হেরার গুহায় প্রিয় নবী (সা)-এর কাছে মহান আল্লাহ যে ওহি পাঠিয়েছিলেন তাতেই রয়েছে নির্ভুল জ্ঞান এবং এই জ্ঞানই মানুষকে দিতে পারে মুক্তির সন্ধান। জ্ঞানের এ পথে চলতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন, কিন্তু কখনো আদর্শ ত্যাগ করেননি। এ প্রসঙ্গে ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন লিখেছেন, ‘বিগত ২২ জুন (১৯৭৪) নজরুল জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সওগাত-সাহিত্য মজলিশের অনুষ্ঠানে বহু কবি-সাহিত্যিকের সমাগম হয়েছিল, কিন্তু অনুষ্ঠানে ফররুখ আহমদকে পাইনি। একজন প্রখ্যাত কবিকে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘আচ্ছা ফররুখ আহমদ এলেন না কেন?’ তিনি বললেন, ‘কবি আজকাল ঘর ছেড়ে বড় বেশি বের হন না। তিনি নাকি ইসলামী তমদ্দুনের কবি, তাই অপরাধী। জানি না কবে পর্যন্ত তাঁর অপরাধের সমাপ্তি হবে এবং তিনি আমাদের সাথে আবার মিলিত হবেন।’ অকস্মাৎ খবরের কাগজে ফররুখ আহমদের মৃত্যুর খবর বেরোল। অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে বিনা চিকিৎসায় শোচনীয় মৃত্যু। তিনি মৃত্যুবরণ করলেন নীরবে কিন্তু আদর্শচ্যুত হয়ে অন্যায়-অসত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন না। নিজের ও পরিবারের লোকদের জীবন রক্ষার তাগিদেও না।’ সওগাত সম্পাদকের এই বক্তব্যের আলোকে কবি ফররুখ আহমদের আদর্শনিষ্ঠা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় ইস্কাটন গার্ডেনের ফ্ল্যাটে ইন্তেকাল করেন।
ফররুখ আহমদ মূলত কবি। ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিরাজাম মুনীরা’ ‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘হাতেম তায়ী’ তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ। এসবই বড়দের জন্য। তবে শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি কম লিখেননি। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ২১টি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়া তিনি ৪টি স্কুলপাঠ্য গ্রন্থও রচনা করেছেন। তবে জীবিতকালে তিনি মাত্র ৪টি শিশু-কিশোর গ্রন্থের প্রকাশনা দেখে যেতে পেরেছেন। বাকিগুলো পা-ুলিপি আকারে পাওয়া যায়। কবির শিশুতোষ ছড়া-কবিতা বইয়ের মধ্যে পাখীর বাসায়, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর, চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, ফররুখের ছড়া-কবিতা শিশু-কিশোরদের মত বড়দের কাছেও সমান প্রিয়। ফররুখের কাব্য পড়ে বড়রা ছোটবেলায় ফিরে যান, শিশুভুবনের আনন্দ উপভোগ করেন। যেমন এই প্রবীণ বয়সে আমিও উপভোগ করছি ফররুখ আহমদের ছড়া-কবিতা। এখানে ফররুখ রচিত আমার প্রিয় ছড়া-কবিতার কিছু কিছু অংশ তুলে ধরছি। যেমনÑ
আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখীর বাসা খুঁজতে যাবো
একসাথে॥
কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়
কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে॥
(পাখীর বাসা)
বাপরে সে কী ধুম ধাড়াক্কা
দিচ্ছে ধাক্কা, খাচ্ছে ধাক্কা,
গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত
হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলা কান্ত !
লাগলো যখন বিষম তেষ্টা
ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা।
তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ,
ভিড়ের ভিতর দেয় সে লাফ।
(মেলায় যাওয়ার ফ্যাঁকরা)
বিষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে
রিমঝিমিয়ে, রিমঝিমিয়ে,
টিনের চালে, গাছের ডালে
বিষ্টি ঝরে হাওয়ার তালে,
হাওয়ার তালে গাছের ডালে
বিষ্টি ঝরে তালে তালে
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
বিষ্টি নামে মিষ্টি মধুর,
যুঁই চামেলী ফুলের বোঁটায়
বিষ্টি নামে ফোঁটায় ফোঁটায়,
বাদলা দিনের একটানা সুর
বিষ্টি নামে ঝমুর ঝুমুর।
(শ্রাবণের বৃষ্টি)
ছোটদের জন্য আরো বহু মজার-মজার ছড়া-কবিতা আছে কবি ফরুরুখ আহমদের। তবে তা পড়তে হলে তোমাদের প্রবেশ করতে হবে তাঁর কাব্যভুবনে। আনন্দ ও আলোর সে ভুবনে তোমাদের স্বাগত জানাই।
ফররুখ আহমদের শিশুতোষ ছড়া-কবিতায় ফুটে উঠেছে শিশুদের আপন ভুবন। রোদ-বৃষ্টি, মেলা, পাখীর বাসা, পোকামাকড়, ফুল, ঘুড়ি, মেঘ, ব্যঙ্গমা কাঠবিড়ালি, বাঘ, ভল্লূক, শিয়াল, জলহস্তীসহ নানা বিষয় আমরা লক্ষ্য করি ফররুখের ছড়া-কবিতায়। ফররুখ যে শুধু প্রকৃতি ও পশু-পাখী নিয়ে লিখেছেন তা নয়। গানে-গানে তিনি শিশু-কিশোরদের আদর্শের পথে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। যেমনÑ
আমরা সকল দেশের শিশু যাব
নবীর মদিনায়,
তোরা সঙ্গে যাবি আয়,
আয় আয় আয়
তোরা সঙ্গে যাবি আয়।
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া,
তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া॥
যে কবি আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াবার আহ্বান জানান, তিনিই তো আমাদের প্রিয় কবি, আপন কবি। এসো, আমরা এই কবির আদর্শে নিজেদের গড়ে তুলি এবং কর্মে ও সৃজনে জাতিকে সমৃদ্ধ করি। হ