Home স্মরণ যুগের নকী ও সমাজ সংস্কারক মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ

যুগের নকী ও সমাজ সংস্কারক মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ

নাসির হেলাল..

নাম মেহেরুল্লাহ। পরবর্তীতে মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। পিতার নাম ওয়ারেছ উদ্দীন। যশোর শহর থেকে মাত্র ৪ মাইল দূরে যশোর-ঢাকা মহাসড়কের ওপর চুড়ামনকাঠি বাজারসংলগ্ন ছাতিয়ানতলা গ্রামে মুন্সী ওয়ারেছ উদ্দীন বাস করতেন। মুন্সী সাহেবের পূর্বপুরুষ দলুঢালী নামক জনৈক ব্যক্তি দক্ষিণে বগা নামক স্থান থেকে এসে ছাতিয়ানতলায় বসতি স্থাপন করেন। আরবির মেহেরুল্লাহ ইবন ওয়ারেছ উদ্দীন ইবন নাছির মাহমুদ ইবন শাহ মাহমুদ ইবন পীর মাহমুদ ইবন মনু খাঁ বা মোনায়েম খাঁ ইবন দলুঢালী।
বারবাজার একটি প্রাচীন স্থান। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য- বারবাজার উক্ত তিন সভ্যতার রাজধানী ছিল। এমনকি এটি প্রাচীনকালে সমতটের রাজধানী ও গাঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী ছিল। এখান থেকেই গাজী কালু সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের সূচনা করেন। হযরত খান জাহান আলী (রহ)ও এখান থেকেই ইসলাম প্রচারের শুভ সূচনা করেন এবং বাগেরহাট গিয়ে খলিফাতাবাদ নামে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। সম্প্রতি বারবাজারের প্রাচীন টিবিগুলোর খননকাজ শুরু হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ছোট বড় মোট আটটি চমৎকার চমৎকার মসজিদ মাটির নিচ থেকে বের হয়েছে। অতএব বলা যায়, নানা কারণেই বারবাজার একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই বারবাজারসংলগ্ন ঘোপ গ্রামে মামার বাড়িতে আজকের আলোচিত ও আমাদের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
বারবাজার বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত একটি বিরাট হাট হিসেবে পরিচিত। এ জন্য একে হাটবার বাজারও বলা হয়। মেহেরুল্লাহ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। এ জন্য তাঁর লেখাপড়া বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। তাছাড়া সে সময় এখনকার মতো এত যেখানে-সেখানে স্কুল-কলেজও ছিল না। তাই মায়ের কাছে ও নিজের চেষ্টায় তাঁর লেখাপড়া চলতে থাকে। ১৪ বছর বয়সে তিনি শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করে কয়ালখালী গ্রামে যান। সেখানে তিনি মৌলভী মেছবাহ উদ্দীনের কাছে তিন বছর এবং করচিয়া গ্রামের মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের কাছে আরো তিন বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি উচ্চ ওস্তাদদ্বয়ের কাছে উত্তমভাবে আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার কারণে অতি অল্প সময়েই তিনি কুরআন ও হাদিসে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করেন। সাথে সাথে শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তা’, ‘বোস্তা’ ও ‘পান্দেনামা’ মুখস্থ করে ফেলেন।
যশোর বাংলাদেশের প্রথম জেলা শহর। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যশোরকে জেলা হিসেবে ঘোষণা দেয়। অবশ্য তারও আগে যশোর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। তখন যশোরের নাম ছিল যশোর রাজ্য ও যশোরাদ দেশ। এ কারণে প্রাচীনকাল থেকেই যশোরে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ছিল। মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ কর্মজীবনের প্রথমে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান যশোর জেলা বোর্ডে চাকরি পান। কিন্তু স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে কিছুদিন পর তিনি সে চাকরি ছেড়ে দেন এবং স্বাধীনভাবে দর্জির কাজ শুরু করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি কাটিং মাস্টার হিসেবে প্রচার খ্যাতি অর্জন করেন। যার কারণে তখনকার যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মানে আজকের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পর্যন্ত তার খরিদ্দার ছিলেন। পরবর্তীকালে মেহেরুল্লাহর কাজে খুশি হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাকে দার্জিলিং নিয়ে যান এবং দোকান করে দেন।
দার্জিলিং যাবার আগে যশোর শহরের কেন্দ্রস্থল দড়াটানা মোড়ে তার দর্জির দোকানে বসে তিনি দেখেছেন মিশনারিদের অপতৎপরতা। এ সময় খ্রিষ্টান মিশনারিগণ সেবার নামে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ও গরিব মুসলমানদেরকে ধর্মান্তর করছিল ঠিক আজকে এনজিও তৎপরতার মাধ্যমে যা করা হচ্ছে। শুনলে আশ্চর্য হবে, সে সময় ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকারের মদদে খ্রিষ্টান প্রচারকগণ প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে আল্লাহ, রাসূল (সা) ও কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতো, নানা কুপ্রশ্ন ছুড়ে দিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে খ্রিষ্টানদের এহেন অন্যায় কাজের মোকাবেলায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি। এসব দেখে শুনে কিশোর মেহেরুল্লাহর মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতো কিন্তু খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো জ্ঞান-গরিমা না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করতে পারতেন না।
মুনশী মেহেরুল্লাহ যখন দার্জিলিং অবস্থান করছিলেন তখন তিনি বাইবেল, বেদ, গীতা, উপনিষক, ত্রিপিটক, গ্রন্থ সাহেব ইত্যাদি ধর্মীয়গ্রন্থ গভীরভাবে পড়ার সুযোগ পান। বিশেষ করে এ সময় তোফাজ্জল মুকতাদী নামক একটি উর্দু গ্রন্থ পড়ে বিভিন্ন ধর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে জানতে পারেন। এরপর হযরত সোলায়মান ওয়াসির লেখা ‘কেন আমি আমার পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম’, ‘প্রকৃত সত্য কোথায়’ ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠেও তিনি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। ব্যস, এতদিন মেহেরুল্লাহ যা চাচ্ছিলেন তা পেয়ে গেলেন। এবার নিশ্চয়ই খ্রিষ্টানদের মোকাবেলায় নামা যায়, কী বল? অতএব যেই ভাবা সেই কাজ।
মেহেরুল্লাহ দার্জিলিং থেকে তল্পিতল্পাসহ ফিরে এলেন যশোর। আবারো দড়াটানায় দেখা গেল তাকে। তবে দর্জি হিসেবে নয়, তুখোড় বক্তা হিসেবে। এরপরই তিনি খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য ছুটলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের অলিতে গলিতে। বক্তৃতা করতে লাগলেন, আরো বেগবান করার জন্য কলকাতার নাখোদা মসজিদে প্রখ্যাত মনীষী ও ইসলাম প্রচারক মুন্সী শেখ আবদুর রহীম, মুন্সী রিয়াজুদ্দীন আহমদের মত ব্যক্তিত্বদের সাথে বসলেন। ঐ বৈঠকেই গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি’। সমিতির পক্ষ থেকে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচারের।
মুন্শী মেহেরুল্লাহর আকর্ষণীয় ও যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় মানুষ এতই আমোদিত হলো যে, দলে দলে অমুসলিমরা মুসলমান হতে লাগলো। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ তার সভা-সমাবেশে উপস্থিত হতো। যাদের মনে নানা দুর্বলতা ছিল, ঘুণে ধরে নষ্ট করেছিল সেসব মনের মানুষগুলো নিজেদেরকে ঠিক ঠাক করে নিলো। তোমরা শুনলে খুশি হবে, সেই সময়কার ইসলাম ও মুসলমানদের সব থেকে বড় শত্রু জন জমিরুদ্দীন মুন্শী মেহেরুল্লাহর কারণেই পুনরায় মুসলমান হন। এ সময় তিনি সারা উপমহাদেশে এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই মানুষের হৃদয়ের বন্ধু। অসাধারণ বক্তা হওয়ার কারণে তাঁকে ‘বাগ্মী কুল তীলক’ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়।
তিনি যে শুধু অসাধারণ বক্তাই ছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁর কলমের ধার ছিল দু’ধারী খোলা তলোয়ারের মত। তিনি খ্রিষ্টান লেখক জন জমিরুদ্দীনের নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ লেখার যুক্তিপূর্ণ লিখিত উত্তর দেন। যা সেই সময়কার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তিনি জাতির কল্যাণের জন্য দশটার মতো গ্রন্থ রচনা করেন। যা তাঁর জীবিত অবস্থায় বহুবার প্রকাশিত হয়। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যদিও আমি ভালো বাংলা জানি না তথাপি ক্রমে ক্রমে কয়েকখানি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করিয়াছি, তদ্বারা সমাজের কতদূর উপকার সাধিত হইয়াছে বলিতে পারি না। তবে এই মাত্র জানি যে, এখন আমি খোদার ফজলে সমুদয় বঙ্গীয় মুসলমানের স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছি। আমি দরিদ্র লোকের সন্তান হইলেও আমাকে আর কোন বিষয়ের অভাব অনুভব করিতে হয় না।’
তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর নাম তোমাদের জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছিÑ
ষ    খ্রিষ্টীয় ধর্মের অসারতা (প্রকাশকাল-১৮৮৬)
ষ    মেহেরুল এছলাম (প্রকাশকাল-১৮৯৫)
ষ    রদ্দে খিষ্টান ও দলিলোল এছলাম (প্রকাশকাল-১৮৯৫)
ষ    জওয়াবোন্নাছারা (প্রকাশকাল-১৮৯৭)
ষ    বিধবাগঞ্জনা ও বিষাদভাণ্ডার (প্রকাশকাল-১৮৯৭)
ষ    হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেবলীলা (প্রকাশকাল-১৯০০)
ষ    পন্দোনামা (প্রকাশকাল-১৯০৮)
ষ    শ্লোকমালা (প্রকাশকাল-১৯১০)
ষ    খ্রিষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ (প্রকাশকাল জানা যায়নি)
ষ    মানবজীবনের কর্তব্য (রচনাকাল ১৩১১ বঙ্গাব্দ, অপ্রকাশিত)
বর্তমানে অবশ্য মেহেরুল এছলাম, রদ্দে খিষ্টান ও দলিলোল এছলাম, বিধবাগঞ্জনা, হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা গ্রন্থ চারটি ছাড়া অন্যগুলো পাওয়া যায় না। তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘মানব জীবনের কর্তব্য’র কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।
অসম্ভব প্রতিভাধর মেহেরুল্লাহ কালজয়ী নাত রচনা করেনÑ
গাওরে মছলেমগণ নবীগুণ গাওরে॥
পরান ভরিয়া সবে ছল্লে আলা গাওরে॥
আপনা কালামে, নবীর ছালামে, তাকিদ করেন বারী॥
কালেবেতে জান, কছিতে জবান, যে তক থাকে গো জারী॥
যে বেশে, যে বেশে যে দেশেতে যাওরে॥
গাও, গাও সবে ছল্লে আলা গাওরে॥
অন্যত্র লিখেছেন
কোথায় আরব ভূমি কোথা বঙ্গ কোথা আমি
পাব কি তোমারে আমি
মোহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ।

মূলত মুন্শী মেহেরুল্লাহ ছিলেন যুগের নকীব, সমাজ সংস্কারক। তাই তিনি তাঁর মিশন শুধু খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধেই চালাননি, তিনি মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে কুসংস্কার বাসা বেঁধে আছে তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। এ সম্বন্ধে হবিবর রহমান সাহিত্যরতœ লিখেছেন, ‘মেহেরুল্লার নানা দিকে উৎসাহ ছিল। তিনি মুসলমান সমাজে ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রচলন করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। উৎসাহ দিতেন কৃষিকাজ করার জন্য। তিনি বলতেন, ‘মুসলমান ঠিকই খাইতে জানে, কিন্তু তৈরি করতে জানে না। পান খাইয়া অজস্র পয়সা নষ্ট করিতে জানে, কিন্তু পানের বরজ তৈরি করা অপমানজনক মনে করে।’ মুনশী সাহেব মুসলমানগণের মিঠাইয়ের দোকান করিতে পানের বরজ তৈরি সর্বস্থানেই উৎসাহ দিতেন, তাঁহার চেষ্টা বহু স্থানেই ফলবতী হইয়াছিল।’
মুন্শী মেহেরুল্লাহর উৎসাহ উদ্দীপনায় বাংলা ও আসামে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তিনি তাঁর প্রত্যেকটি আলোচনায় শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতেন। ১৯০১ সালে নিজ গ্রামের পাশের গ্রাম মনোহরপুরে ‘মাদ্রাসায়ে কারামাতিয়া’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি বর্তমানে ‘কর্মবীর মুন্শী মহেরুল্লাহ একাডেমী’ নামে পরিচিত।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য আমরা ১৯৫২ সালে জীবন দিলেও ভাষা আন্দোলন তার বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়। সে সময়েও মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অনেকেরই অনীহা ছিল। এ জন্য মেহেরুল্লাহ লিখেছেন, ‘মাতৃভাষা বাংলা লেখাপড়ায় এত ঘৃণা যে, তাহারা তাহা মুখে উচ্চারণ করাই অপমানজনক মনে করেন। এই অদূরদর্শিতার পরিণাম কী সর্বনাশা তাহা ভাবিলে শরীর শিহরিয়া ওঠে। যে দেশের বায়ু, জল, অন্ন, ফল, মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ, ঘৃত খাইয়া তাহাদের শরীর পরিপুষ্ট সে দেশের ভাষার প্রতি অনাদর করিয়া তাঁহারা যে কী সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করিতেছে তাহা ভাবিলেও প্রাণে এক ভীষণ আতঙ্ক উপস্থিত হয়।’
মুন্শী মেহেরুল্লাহর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তৎকালীন সময়ে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান সমাজে উপস্থিত বুদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি ছিল না। তোমরা শুনে পুলকিত হবে যে, উপস্থিত তর্কে তিনি কখনো কারো কাছে পরাজিত হননি। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি সম্বন্ধে বহু কিংবদন্তি এখনো বাংলা ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মুন্শী মেহেরুল্লাহ গল্প কথক হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশেও উপদেশচ্ছলে গল্পগুলো শুনাতেন। তোমরা চোখ-কান খুলে জানতে চেষ্টা করলে এসব গল্পও বইপত্রে পেয়ে যাবে।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যাঁরা তাঁর উৎসাহ উদ্দীপনায় খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা হলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কবি গোলাম হোসেন শেখ, হবিবর রহমান সাহিত্যরতœ, মুন্শী শেখ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, মাওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ। সিরাজীর অনল প্রবাহ কাব্য তো মুন্শী মেহেরুল্লাহই প্রথম প্রকাশ করেন।
মোটকথা মুন্শী মেহেরুল্লাহ ছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এক অনুকরণীয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এ জন্যই নোয়াখালীর কবি আবদুর রহীম ‘আখলাকে আহমদিয়া’ নামক পুস্তকে মুন্শী মেহেরুল্লাহর জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে লেখেন বিশাল এক কবিতা, যার চার লাইন প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
মুন্শী মেহেরুল্লাহ শেষ জীবনে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তাঁর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) মনোনীত হন। পরের বছর ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি সমাবেশে একাধারে বক্তব্য রাখার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজ বাড়ি ছাতিয়ানতলায় চলে আসেন। চিকিৎসাও চলতে থাকে কিন্তু কয়েকদিন পর ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ২৪ জ্যৈষ্ঠ সবাইকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ইনতেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেই সময়কার বাংলা ও আসামের পত্রপত্রিকায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। এমনকি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদিও ছাপা হয়। মিহির ও সুধাকর পত্রিকা লিখেছিল, ‘ভাই বঙ্গীয় মুসলমান। আজ তোমরা প্রকৃত বন্ধু হারাইলে।’ ইসলাম প্রচারক লিখেছিল, ‘আমাদের প্রাণের ভাই অকালে চলিয়া গিয়াছেন। আমাদের হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়াছে। … বঙ্গের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে।’
তাঁর মৃত্যুসংবাদে ইসমাইল হোসেন সিরাজী তাঁর শোকোচ্ছ্বাস কবিতায় লিখেছিলেনÑ
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায়, নতুন জীবন ঊষা
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে সমাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন, বিশ্বময় অন্ধকার।

মুন্শী মেহেরুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন প্রায় এক শতাব্দীকাল আগে। কিন্তু এই একশ বছরের মাথায় এসে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আবারো মাঠে নেমেছে তাদের অপতৎপরতা চালানোর জন্য। মুন্শী মেহেরুল্লাহ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু আছে তাঁর কর্মময় জীবন ও সাহিত্য। তাঁর জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখব একজন ইয়াতিম ও অল্পশিক্ষিত বালক কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, কিভাবে আপন জাতির অস্তিত্বকে ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠীর মরণছোবল থেকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

SHARE

2 COMMENTS

  1. সত্যি বলতে, মুনসী মেহের উল্লাহকে আমরা ভুলতে বসেছি। আসলেই একজন দরিদ্র, এতীম, দর্জি হয়েও অসীম সাধনায় তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলে জাতির মাঝে আত্মবিস্মৃতির জোয়ারের বিপরীতে শক্তিশালী ঢেউয়ের সৃষ্টি করা…. ক’জনই বা পেরেছে? কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী যথার্থই বলেছেন,
    সেই মহাজন করিয়া যতন অপূর্ব বাগ্মিতাবলে,
    নিদ্রিত মোসলেমে ঘুরি গ্রামে গ্রামে জাগাইলা দলে দলে।

    মুনশী মেহের উল্লাহকে হারিয়ে কবির মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে বলেছিলেন-
    “শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা আঁধার আইল ছুটি,
    বুঝিবি এখন বঙ্গবাসিগণ কি রতন গেল উঠি।”

    কিন্তু সে চেতনাবোধ আমাদের কী আছে? কবিই বলেছেন-
    এই পতিত জাতি আঁধারেই রাতি পোহাবে চিরকাল,
    হবে না উদ্ধার বুঝিলাম সার কাটিবে না মোহজাল।

    দুআ করি আল্লাহ যেনো আমাদের এই ভগ্নদশা থেকে পরিত্রাণ দান করেন, আমীন।

  2. উনার বই ‘হিন্দু ধর্ম দেবলীলা ও রহস্য’ পাব কোথায় ???

Leave a Reply