আবু হেনা আবিদ জাফর

হাসি সুখ, আনন্দ ও সুস্থতার প্রতীক। হাঁচি কিংবা কাশির শব্দ শুনলে যেমন আমরা বুঝতে পারি অসুস্থতা, তেমনি হাস্যরসের আওয়াজ শুনলে আমরা বুঝি বিরাজ করছে সুখ, আনন্দ ও সুস্থতা। হাসি প্রাকৃতিক, হাসি স্বাভাবিক। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রকৃতি। বিকেলে মিষ্টি রোদে হাসে প্রকৃতি। রাতে চাঁদের স্নিগ্ধ হাসিতে মেতে ওঠে পৃথিবী। ফুলের হাসি, বাতাসের মৃদুমন্দ শিহরণ, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ, পাখির উচ্ছ্বাস গান, নদীর কলকল হাস্যধ্বনি সব মিলিয়ে আমাদের আনন্দের অনুভূতিকে মুগ্ধ করে প্রকৃতি। তাই বলছিলাম, প্রকৃতির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হাসি।
হাসতে নাকি জানে না কেউ
কে বলেছে ভাই,
এই শোন না কত হাসির
খবর বলে যাই
খোকন হাসে ফোকলা দাঁতে,
চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে,
কাজল বিলে শাপলা হাসে,
হাসে সবুজ ঘাস,
খলসে মাছের হাসি দেখে,
হাসেন পাতিহাঁস…
হ্যাঁ, প্রকৃতিতে স্বাভাবিক অবস্থায় সার্বক্ষণিক বিরাজ করে, বিষাদ নয় আনন্দ। কিন্তু জীবনযুদ্ধে, নাগরিক ব্যস্ততায়, সাফল্যের প্রতিযোগিতায় আমরা হারিয়ে ফেলি সে আনন্দ। ফুলের সুগন্ধ নেয়ার সময় নেই আমাদের, পাখির গান শোনার সময় কই! আমরা দ্রুত ধাবমান ফাস্ট ফুডের প্রতি, ওয়ান স্টপ শপিং মল কিংবা ই-ব্যাংকিংয়ের দিকে। ফলে আমাদের জীবন থেকে ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দ। দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমরা। তাই আমাদের এখন আবার ফিরে যেতে হবে ‘হাসি’র কাছে।
তোমরা হয়তো অবাক হচ্ছো। কিন্তু হ্যাঁ, সত্যিই হাসির রয়েছে নানা মনোদৈহিক উপকারিতা। হাসি শুধু মজা করার জন্য নয়, হাসি আমাদের অনেক দিক দিয়ে সুস্থ রাখতে পারে, পারে অসুস্থকে ভালো করে তুলতে এ কথা বৈজ্ঞানিক সত্য। হাসি শক্তিদায়ক, হাসি আমাদের রোগ প্রতিরোধক শক্তিকে উজ্জীবিত করে, হাসি ব্যথা লাঘব করে এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন ইন বাল্টিমোর-এর গবেষকরা রোগ নিরাময়ে হাসির প্রয়োগ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তারা প্রমাণ পেয়েছেন, রোগ নিরাময়ে হাসি উপকারী। তারা বলেছেন, অবদমিত ক্রোধ, ঘৃণা আমাদের ইম্যিউন সিস্টেমকে নিস্তেজ করে দেয়। অপরপক্ষে হাসি, আনন্দ ইম্যিউন সিস্টেমকে উজ্জীবিত করে। ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিন্ডা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা দেখিয়েছেন, হাসি আমাদের ইম্যিউন সিস্টেমকে উত্তেজিত করে শ্বেতকণিকা ‘টি’ সেল তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে, ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি দৃঢ় হয়, নানা জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে আমরা বিজয়ী হতে পারি। আমরা যখন হাসি তখন আমাদের রক্তচাপ কমে যায়। বৃদ্ধি পায় ন্যাচারাল কিলার সেল যারা হিউমার ধ্বংস করে ও ভাইরাসকে মেরে ফেলতে সক্ষম। বৃদ্ধি পায় গামা ইন্টারফেরন, টি সেল ও বি সেল, ফলে বেশি বেশি তৈরি হয় অ্যান্টিবডি। হাসি শ্বাসতন্ত্রকে পরিষ্কার করে দেয় শ্বাসনালীতে লেগে থাকা মিউকাস ছুটিয়ে দিয়ে। এ সময় বেড়ে যায় থুথুতে নিঃসৃত স্যালিভারি ইম্যিউনোগে¬াবিউলিন এ’য়ের পরিমাণ। ফলে তা শ্বাসতন্ত্রে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিহত করে।
এ ছাড়া হৃদরোগে হাসি ধন্বন্তরি। সেন্টার ফর প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজির পরিচালক ডা. মাইকেল মিলারের নেতৃত্বে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল চিকিৎসা বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন গবেষণা করে হাসির সাথে রক্তনালীর সুস্থতার সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রায় ৩০০ ব্যক্তি। যাদের অর্ধেকের বাইপাস সার্জারি করা হয়েছে বা যারা হার্ট অ্যাটাকে ভুগেছেন। তারা দেখেছেন, হৃদরোগীদের উৎফুল্ল হওয়ার প্রবণতা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। দেখা গেছে, বিষণœতা বা দুশ্চিন্তায় এদের রক্তপ্রবাহ প্রায় ৩৫% ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথচ হাসি আনন্দে এদের রক্তপ্রবাহ প্রায় ২২% বৃদ্ধি (Vasodilatation) পায় এবং এন্ডোথেলিয়াম সুদৃঢ় হয়। যুক্তরাজ্যেও গবেষণায় একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি তাই মন্তব্য করেছে, এখন থেকে বলতে হবে হৃদরোগ প্রতিরোধে এক্সারসাইজ, ধূমপান থেকে দূরে থাকা, স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা কোলেস্টেরল-বর্জিত খাদ্য খাওয়ার মতোই হাসি আনন্দময় জীবন গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট সেন্টার অব আমেরিকার (CTCA) ন্যাশনাল ডিরেক্টর ডা. ক্যাথরিন পুকেট মিড-ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল মেডিক্যাল সেন্টারে প্রচলিত অ্যান্টিক্যান্সার চিকিৎসার পাশাপাশি ‘Laughter Therapy’ প্রয়োগ করে বিস্ময়কর ফলাফল পেয়েছেন। শুধু ঔড়শবং বা কৌতুকপূর্ণ মুভি দেখা নয়, তিনি প্রচলন করেছেন কিছু হাস্যকর (!) শারীরিক কসরতের (Laughter Exercise)। এতে ক্যান্সার রোগী ও তার স্বজনরা অংশগ্রহণ করে আনন্দদায়ক অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, হাসি ক্যান্সার সারাতে পারবে না বটে কিন্তু জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়, জীবনযাপন সহজ করে তোলে।
বিষণœতা, ব্যথা এবং মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিরোধক হিসেবে হাসির জুড়ি নেই। কৌতুক কিংবা ক্ষণিক আনন্দ আমাদের মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়। প্রাণ খুলে হাসুন শরীর মন চাঙা হয়ে উঠবে অন্তত ৪৫ মিনিটের জন্য। একটি বিখ্যাত ইংরেজি উক্তি আছে এরকম A clown is like an Aspirin, only he works twice as fast. আমরা যখন হাসি তখন আমাদের শরীর রিল্যাক্স হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, আনন্দময় হাসির সাথে সাথে শরীরে এন্ডোরফিন (Endorphin) ও সেরোটনিন (Serotonin) নিঃসরণ হয়। আর Endorphin বলা হয় natural pain killer। হাসি স্ট্রেস হরমোনগুলোর নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, ফলে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়।
কঠিন বিরূপ পরিস্থিতিতে অবলীলায় হাসতে পারা এক বিরল যোগ্যতা। আপনি যখন হাসতে থাকেন, তখন কোন বিষণœতা, ক্রোধ, দুশ্চিন্তা বা দুঃখবোধ আপনাকে গ্রাস করতে পারে না। হাসি আপনার মনকে ভালো করে দেয় এবং এই ভালো লাগা রয়ে যায় হাস্য-কৌতুকের পরিবেশ থেকে চলে আসার পরও অনেকক্ষণ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১০০ বার হাসি ১০ মিনিট নৌকা চালানো কিংবা ১৫ মিনিট সাইকেল চালানোর সমান শারীরিক কসরত। রক্তচাপ কমে যায় বটে কিন্তু শারীরিক সঞ্চালনের

কারণে সবখানে রক্ত চলাচল যায় বেড়ে। রক্তে সংযুক্ত হয় বেশি পরিমাণ অক্সিজেন। হাসিতে ডায়াফ্রাম, পেটের ও রেসপিরেটরি মাংসপেশিসমূহ এবং মুখ, এমনকি পা কিংবা পিঠের মাংসপেশির চমৎকার এক্সারসাইজ হয়। এজন্য উচ্চ হাসির পর আমরা খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং হাঁপাতে থাকি। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন ও গভীর হয়ে পড়ে। শরীরের অভ্যন্তরেও ঘটে অনেক শারীরবৃত্তিক ও রাসায়নিক পরিবর্তন। সব মিলিয়ে এ যেন খানিকটা ‘অ্যারোবিক’ শরীরচর্চা। তাই বলা হয় হাসি থেকে ওজন কমার মতো উপকারও পেতে পারি। এ ছাড়া হাসি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়, হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা কমায়। আমাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় বিরাট ভাবে। হাসির জানালা দিয়ে উবে যায় যে কোন চাপা ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ কিংবা গ্লানিবোধ, যা হয়তো বড় কোন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারতো।
তাই বলা হয়, হাসি শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক ওষুধ। বিনা খরচে হাসি রোগমুক্তি দেয়। এর জন্য তোমার কোন জিমে যাওয়ার দরকার নেই। দরকার নেই কোন প্রশিক্ষণের। হাসি আমাদের জন্মগত প্রবৃত্তি। নবজাতক শিশু জন্মের প্রথম সপ্তাহেই হাসতে শুরু করে এবং প্রথম মাসেই সশব্দে হাসতে পারে। বড় হতে হতে গাম্ভীর্য এসে ভর করে আমাদের ওপর। তাই হাসি শিখতে হলে, প্রাণ খুলে হাসতে হলে তাকাতে হবে শিশুদের দিকে। তাদের দুনিয়া আনন্দময়। তুচ্ছ কারণে তারা হাসতে পারে। হাসার জন্য তাদের কোন লজিক লাগে না। তাই এসো আমরা বেশি বেশি হাসি, জীবনকে আনন্দময় করে তুলি এবং সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করি।