গাছের ডালে পাখির ছানা

গাছের ডালে পাখির ছানা

গল্প মাসুদ রানা আশিক এপ্রিল ২০২৪

নতুনভাবে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছে রাজুর বাবা। আগে ছিল টিনের বাড়ি। সবকিছুর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাড়িটাও আধুনিক করতে হচ্ছে। টিন বাদ দিয়ে দালান হবে এখানে। রাজুর আনন্দ হওয়ার কথা। অথচ রাজুর ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। কারণ বাড়ির পাশে লাগানো বেশ কয়েকটা গাছ কাটতে হবে। গাছ না কাটলে বাড়িটা বড়ো করা যাবে না। যে কয়টা গাছ কাটা পড়বে সেগুলো সব তার দাদুর হাতে লাগানো গাছ। ছোটোবেলায় রাজু দেখেছে দাদু গাছগুলোকে নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখতেন। রাজুকে দাদু বলতেন, ‘শোন দাদু ভাই। এই যে গাছগুলো দেখছিস। এগুলো একসময় চারা ছিল। আমি চারাগুলো রোপণ করার পর থেকেই খুবই যত্ন করেছি। যত্ন করার কারণে সেই চারাগুলো এখন বৃক্ষ। এই বৃক্ষগুলো এখন পুরো বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিচ্ছে। একেকটা গাছ হচ্ছে একেকটা অক্সিজেন ব্যাংক। ব্যাংকে যেমন মানুষের টাকা সুরক্ষিত থাকে। তেমনি গাছে আমাদের অক্সিজেন সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে। এই গাছগুলো থেকে কাঠ হবে। সেই কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি হবে। প্রয়োজনে এই গাছ বিক্রি করে অনেক টাকাও উপার্জন হবে। গাছ হলো সম্পদ। সম্পদের যত্ন নিতে হয়। যত্ন না নিলে মূল্যবান সোনাও এক সময় নষ্ট হয়ে যায়।’

রাজুর বাবা বেশ কয়েকবার গাছের ডাল কাটার চেষ্টা করেছিলেন। দাদু গাছগুলোর ডালও কাটতে দিতেন না। বলতেন, ‘তুমি যে ডাল কাটতে চাচ্ছো সেই ডালে পাখি বাসা বানাতে পারে। ডালগুলো কাটলে ওদের কষ্ট হবে। ওদের বাসস্থান নষ্ট হবে। পাখিদের কষ্ট দেওয়ার অধিকার বিধাতা আমাদের দেয়নি।’

এখন দাদুর কথা খুব মনে পড়ছে রাজুর। দাদুর হাতের লাগানো গাছগুলো বাড়ি বানানোর কাজে কেটে ফেলতে হবে। দাদু মারা যাওয়ার পর রাজুই যত্ন নিত গাছগুলোর। গাছগুলোর আশপাশের আগাছা পরিষ্কার করতো। মাঝে মাঝে পানি দিতো। একটা গাছের নিচে মাচান বানিয়েছে রাজু। তীব্র গরমে সেখানে বসে থাকলে বাতাস পাওয়া যায়। মোট চারটা গাছ কাটতে হবে। চারটাই কড়ই গাছ। অনেক বড়ো হয়ে গেছে গাছগুলো। গাছগুলো রাজুর বাবা চার লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাড়িটা বড়ো করতে টাকাগুলো অবশ্যই কাজে লাগবে। দাদু ঠিকই বলেছিল। মাত্র একশো টাকার চারাগাছ এখন লাখ টাকার সম্পদ। রাজু জানে গাছগুলোর বেশ কয়েকটা ডালে অনেকগুলো পাখির বাসা আছে। সেই বাসায় ছানা আছে বেশ কয়েকটা। রাজু কয়েকদিন আগে গাছের তলায় ডিমের অবশিষ্টাংশ দেখেছে। এখন কি গাছ কাটা ঠিক হবে? পাখিগুলোকে আবাসহীন করা অন্যায়। ওরা আবাসহীন হলে ছানাগুলো হয়তো মারা যাবে। যে ছানাকে এত কষ্ট করে বড়ো করছে মা। সেই মায়ের কষ্ট হবে খুব। এটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। নিজের মায়ের কথা চিন্তা করে রাজু। ওর সামান্য জ্বর হলেই মা দিশেহারা হয়ে যায়। ডাক্তার-বৈদ্য ডেকে হুলুস্থুল অবস্থা হয় তখন। পাখিরারও তো মা। সন্তানের জন্য ওদেরও কষ্ট হয়।

আজ সকাল সকালই গাছ কাটার মানুষগুলো চলে এসেছে। রাজুর বাবাও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। গাছ কাটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই দৌড়ে যায় রাজু। বাবাকে বলে, ‘বাবা গাছগুলো কয়েকদিন পর কাটলে হয় না? গাছগুলোর মাথার কয়েকটা ডালে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। ওদের বাসায় ছানা আছে। তুমি ওদের কিচিরমিচির শোনো না? এখন গাছ কাটলে ওদের বাসার ছানাগুলো মারা যাবে বাবা। ওদেরকে রক্ষা করাও তো আমাদের দায়িত্ব। মানুষ হিসাবে আমাদের অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। আমরা তো সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টির সেরা জীব কখনো অন্য জীবকে কষ্ট দিতে পারে না।’

রাজুর বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, ‘কিন্তু রাজু, আমরা তো সব ঠিক করে ফেলেছি। আজ গাছ কাটা হবে। তারপর বাড়িটা বানানো হবে। যারা গাছ কাটতে এসেছে তাদের সময়ের তো মূল্য আছে। সময়ের মূল্য রচনা পড়োনি তুমি? সময়কে মূল্য যে দিতে জানে না সে কিন্তু ভবিষ্যতে বড়ো কিছু হতে পারে না।’

বাবার কথা সঠিক। সময়কে অবহেলা করা ঠিক নয়। রাজুর মাথায় বুদ্ধি এলো, ‘শোনো বাবা, আমরা এক কাজ করতে পারি। আমরা তো আর সব গাছ কাটছি না। মাত্র ৪টা গাছ কাটছি। গাছের মাথায় যে কয়টা পাখির বাসা আছে। সেই বাসাগুলো আমরা স্থানান্তর করতে পারি অন্য গাছগুলোতে। এতে পাখিগুলোর বাসা অক্ষত থাকলো। বাসায় থাকা ছানাগুলোরও কোনো ক্ষতি হলো না। গাছগুলোও সময়মতো কাটা গেল।’

রাজুর কথায় সায় জানালো বাবা। দুজন গাছের ওপর উঠে ৫টা পাখির বাসা পেল। বাসাগুলোতে ১২টা ছানা ছিল। সেই বাসাগুলো ছানাসহ অন্যান্য গাছে স্থানান্তর করা হলো। যদিও এই কাজ করতে সমস্যা হয়েছে। কারণ বাসায় থাকা পাখিগুলো ভয় পেয়ে, নিজের সন্তানকে রক্ষা করার জন্য আঘাত করার চেষ্টা করেছিল। পরে যখন তারা বুঝতে পারলো তাদের বাসাকে স্থানান্তর করা হচ্ছে, তখন আর আঘাত করেনি। এরপর গাছ কাটা শুরু হলো। তবে রাজু তার বাবাকে দিয়ে দিলো আরেকটা শর্ত। সে তার বাবাকে বললো, ‘বাবা, আমরা আজ ৪টা গাছ কাটছি। চারটা গাছের জায়গায় আমাদের অন্তত ৮টা চারাগাছ লাগানো উচিত। কারণ সবগুলো গাছ নাও হতে পারে। ওরা গাছ কাটবে।

আমি আর তুমি যাবো কোনো নার্সারিতে গাছের চারা কেনার জন্য। কোথায় কোথায় চারাগুলো লাগাবো সেই জায়গা আমি ঠিক করে রেখেছি। দাদুর মতো আমিই চারাগুলোর যত্ন নেবো এবং তুমি নিশ্চিত থাকো বাবা, নতুন লাগানো চারাগুলো একদিন বৃক্ষ হবে এবং সেটা আমাদের জন্য হবে সম্পদ। দাদুর লাগানো সম্পদ আজ তোমার উপকার করছে। আজ লাগানো সম্পদ একদিন আমার উপকার করবে।’ রাজুর বাবা অনেক বোঝায়। আজ নয়, অন্য কোনোদিন গাছের চারা কিনে এনে লাগাবো। কিন্তু রাজু কোনোভাবেই সেটাতে রাজি হয় না। শেষে রাজুর বাবা রাজি হয়। বাবা এবং ছেলে চলে নার্সারির উদ্দেশে। রাজুর মন খারাপ এখন আর নেই। রাজু সিদ্ধান্ত নেয় ওর দাদুর মতো নিজের হাতে সম্পদ রোপণ করবে সে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ